ইভা

 

ইভাকে অতো আদর করে কথাটা বললাম। সে আমাকে পাত্তাই দিলো না। চোখমুখ শক্ত করে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলো। আমি স্পষ্ট চোখে চাইলাম তার দিকে। ভারি মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। ওর উপর রাগ করে থাকতে পারি না। বিবাহ বহির্ভুত বড় সাধের সম্পর্ক তার সাথে। ঘরে থাকা শশীর সাথে চি ট করছি প্রতিনিয়ত। সব তো ওই ইভার জন্যই! এই স্যাক্রিফাইসের মূল্য যদি সে বুঝতো! 

এগিয়ে এসে ইভার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। ও আমার বুকে ধাক্কা দিলো। খুব নাকি ঢং করছি! একটা সিগারেট ধরিয়ে ইভা খোলা জানালার এক কোণায় কনুই রেখে কায়দা করে টানতে থাকে। টেবিলে রাখা ভদকার আধ খাওয়া বোতল। বিছানা এলোমেলো। আমাদের ওসব হয়ে টয়ে গেছে। এর মাঝে শশী বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমার রাগ হচ্ছে শশীর উপর। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। এখনো অতো আদর্শ গিন্নী সেজে ঘন ঘন খোঁজ নেবার কী দরকার তোর? সারাক্ষণ একটা ছোকছোক করা সন্দেহ মনে পুষে রাখে। দুদন্ড স্বস্তি দেবে না! 

ইভার সাথে মনোমালিন্য আমার সতী সাবিত্রী গিন্নীকে কেন্দ্র করেই। ইদানীং ইভা নাকি গিল্টি ফিল করে। একটা লক্ষ্মী মেয়েকে নাকি তার কারণে নাকি আমি প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছি! আমার প্রতিটা চুমুতে নাকি প র কী য়া র স র্ব না শা ঘ্রাণ পায় সে। আমি তাকে বোঝাতে পারি না, ওসব সস্তা মূল্যবোধের ধার না ধেরে সময়টাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলে কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। গুগল ঘেঁটে তাকে রেফারেন্স দেখাই। সেখানে কিছু আর্টিকেলে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাসহ লেখা আছে, মানুষ জন্মগতভাবেই ব হু গা মী! 

দু’ভরি পিওর গোল্ডের গহনা কিনে দেবার পর ইভার মনটা নরম হয়। হাসকি ভয়েজে বলে, ওই মা গী যদি নিজের বরকে সামলে সুমলে রাখতে না পারে, তবে তো কোনো নি ম্ফো ম্যা নি য়া কে র ভোগে যাবেই! আমি ওর অসংলগ্ন আদুরে কথা শুনে খিকখিক করে হাসি। জীবনটাকে আমার বড় মধুর মনে হয়। দামী মদকে মনে হয় মায়ের শাড়ির আঁচলে শৈশবের বাটি ছাঁট করা চুল মুছিয়ে দেয়া মমতার মতো। আমার ঘোর কাটায় শশীর একের পর এক অভিমানমাখা মুঠোফোন বার্তা।  

রাত করে বাড়ি ফিরি। পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছে আদর্শ গিন্নী। আরে যতোই খোলামেলা হও, ওসব থলথলে চর্বিযুক্ত হাতির পিঠে ক্লান্ত আমি চড়বো ভেবেছো! কথা কাটাকাটির মাঝখানে দুমদুম কয়েকটা কিল বসিয়ে দেই। ও পিঠখোলা জায়গাটা দেয়ালে ঠেসে ধরে বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। গায়ে এর আগে হাত তুলিনি। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। টেবিলে সাজিয়ে রাখা কয়েক পদের খাবার বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। সাধ করে রেধেছিলো সে।

ইভার কাছে থাকার সময় শশী যতোবার মুঠোবার্তা পাঠিয়েছে, একবারও অ্যানিভার্সারির কথা জানায়নি আমাকে। আমি তো বুঝি। ওসব ওর স র্ব না শা জে দ আর ই গো! যেন আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই। পৃথিবীর যাবতীয় খুঁটিনাটি তুচ্ছ বিষয়াদি মনে করে বসে থাকবো। আমার সামনে কাঁদবে না বলেই হয়তো শশী ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে। আমার খুব ইচ্ছা করে, লাঠিগোছের শক্ত কিছু একটা দিয়ে কয়েকটা ঘা বসাই জায়গামতো। আমার সাথে ন্যা কা মি! আমার চরিত্র নিয়ে বাসায় ঢুকবার সাথে সাথেই বেশ কিছু কথা শুনিয়েছে সে। এখনো মাথায় আগুনের দাপাদাপি থামেনি। 

আমি অবচেতনভাবে নেটে খুঁজি খুন করে লাশ গুম করে ফেলার কার্যকরী উপায়গুলো। কোনোটাই মনে ধরে না। পোহাতে ইচ্ছা করে না এতো ঝক্কিঝামেলা। মা ল টা কে ডি ভো র্স দিয়ে দিলে কেমন হয়? আমি ইভাকে উইল ইউ ম্যারি মি কথাটা লিখে কয়েকটা চুমুর ইমো অ্যাড করছি, এমন সময় সাইড টেবিলে রাখা ফাইলটা চোখে পড়ে। নিতান্ত হেলায় ভরে সেটাকে হাতে নিই। ঠিক মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। একটা কাগজে অনেক কিছুর ফাঁকে স্পষ্ট করে লেখা, শশী সন্তানসম্ভবা। 

আমি মেসেঞ্জারে টেক্সটটা তবু ইভাকে পাঠিয়েই দেই। দেখি না সে কি বলে! 

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই ব্যালকনির দিকে। শশীর বাঁধভাঙা শোকের প্রকোপ কমেছে। ফর্সা পিঠের দু তিন জায়গা লাল হয়ে আছে। ছোটবেলায় শেখা মার্শাল আর্ট এই প্রথম বোধহয় কাজে লাগলো। তবু আমি মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলাম। যাহ্‌… ব্যাপারটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো! 

ও কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি স্যরি বলবো কিনা ভাবছি। এমন সময় ইভা টেক্সটের রিপ্লাই করে। কোনোভাবে ইভা আর শশীর যোগাযোগ হয়েছে। সেই সুযোগে খুব সম্ভবত শশী মা হবার ট্রাম্পকার্ড ছেড়েছে বরকে একান্ত নিজের করে নেবার জন্য। আর ইভা গিল্টি ফিলিং এর দোহাই দিয়ে সম্পর্ক গুটিয়ে নেবার ফাঁকে শেষ লাইনে আমাকে উত্তর দিয়েছে, আমি একজন মোটা দাগের অমানুষ! 

খুব প্রতারিত মনে হয় নিজেকে। অসহায় লাগতে থাকে। নিজে থেকেই শশীর পিঠে কয়েকটা চুমু খাই। হাত ধরে ওকে বেডরুমে নিয়ে আসি। ওর কোমর দু’হাতে জড়িয়ে পেটে কান রেখে কিছু একটা শোনার ভান করে কালক্ষেপন করি। কাঁপা গলায় বলি, আমাকে ক্ষমা করে দিতে। শশী দেখলাম হাসছে। মেয়েটা মা হবার আনন্দে খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেলো নাকি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার অদ্ভুত হাসিটা থামবার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই সাইড টেবিলে চোখ পড়ে আবারো। সেখানে যত্নসহকারে আরেকটা ফাইল রাখা আছে। 

আমি বুঝতে পারি ওটা কীসের আবেদনপত্র। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে আমার। এই মেয়েটার সাথে আমার জীবনের অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠি আমি। শশীর দু পা জড়িয়ে ধরে কাঁদি শিশুর মতো। নিজেই চমকে উঠি, অতোটা বিশুদ্ধ আবেগ ওর জন্য আমার ভেতর এতোদিন লুকিয়ে ছিলো!

লেখক ঃ Taimoor Mahmud Shomik-

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন