ছোট গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ছোট গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ইভা

 

ইভাকে অতো আদর করে কথাটা বললাম। সে আমাকে পাত্তাই দিলো না। চোখমুখ শক্ত করে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলো। আমি স্পষ্ট চোখে চাইলাম তার দিকে। ভারি মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। ওর উপর রাগ করে থাকতে পারি না। বিবাহ বহির্ভুত বড় সাধের সম্পর্ক তার সাথে। ঘরে থাকা শশীর সাথে চি ট করছি প্রতিনিয়ত। সব তো ওই ইভার জন্যই! এই স্যাক্রিফাইসের মূল্য যদি সে বুঝতো! 

এগিয়ে এসে ইভার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। ও আমার বুকে ধাক্কা দিলো। খুব নাকি ঢং করছি! একটা সিগারেট ধরিয়ে ইভা খোলা জানালার এক কোণায় কনুই রেখে কায়দা করে টানতে থাকে। টেবিলে রাখা ভদকার আধ খাওয়া বোতল। বিছানা এলোমেলো। আমাদের ওসব হয়ে টয়ে গেছে। এর মাঝে শশী বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমার রাগ হচ্ছে শশীর উপর। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। এখনো অতো আদর্শ গিন্নী সেজে ঘন ঘন খোঁজ নেবার কী দরকার তোর? সারাক্ষণ একটা ছোকছোক করা সন্দেহ মনে পুষে রাখে। দুদন্ড স্বস্তি দেবে না! 

ইভার সাথে মনোমালিন্য আমার সতী সাবিত্রী গিন্নীকে কেন্দ্র করেই। ইদানীং ইভা নাকি গিল্টি ফিল করে। একটা লক্ষ্মী মেয়েকে নাকি তার কারণে নাকি আমি প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছি! আমার প্রতিটা চুমুতে নাকি প র কী য়া র স র্ব না শা ঘ্রাণ পায় সে। আমি তাকে বোঝাতে পারি না, ওসব সস্তা মূল্যবোধের ধার না ধেরে সময়টাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলে কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। গুগল ঘেঁটে তাকে রেফারেন্স দেখাই। সেখানে কিছু আর্টিকেলে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাসহ লেখা আছে, মানুষ জন্মগতভাবেই ব হু গা মী! 

দু’ভরি পিওর গোল্ডের গহনা কিনে দেবার পর ইভার মনটা নরম হয়। হাসকি ভয়েজে বলে, ওই মা গী যদি নিজের বরকে সামলে সুমলে রাখতে না পারে, তবে তো কোনো নি ম্ফো ম্যা নি য়া কে র ভোগে যাবেই! আমি ওর অসংলগ্ন আদুরে কথা শুনে খিকখিক করে হাসি। জীবনটাকে আমার বড় মধুর মনে হয়। দামী মদকে মনে হয় মায়ের শাড়ির আঁচলে শৈশবের বাটি ছাঁট করা চুল মুছিয়ে দেয়া মমতার মতো। আমার ঘোর কাটায় শশীর একের পর এক অভিমানমাখা মুঠোফোন বার্তা।  

রাত করে বাড়ি ফিরি। পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছে আদর্শ গিন্নী। আরে যতোই খোলামেলা হও, ওসব থলথলে চর্বিযুক্ত হাতির পিঠে ক্লান্ত আমি চড়বো ভেবেছো! কথা কাটাকাটির মাঝখানে দুমদুম কয়েকটা কিল বসিয়ে দেই। ও পিঠখোলা জায়গাটা দেয়ালে ঠেসে ধরে বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। গায়ে এর আগে হাত তুলিনি। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। টেবিলে সাজিয়ে রাখা কয়েক পদের খাবার বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। সাধ করে রেধেছিলো সে।

ইভার কাছে থাকার সময় শশী যতোবার মুঠোবার্তা পাঠিয়েছে, একবারও অ্যানিভার্সারির কথা জানায়নি আমাকে। আমি তো বুঝি। ওসব ওর স র্ব না শা জে দ আর ই গো! যেন আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই। পৃথিবীর যাবতীয় খুঁটিনাটি তুচ্ছ বিষয়াদি মনে করে বসে থাকবো। আমার সামনে কাঁদবে না বলেই হয়তো শশী ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে। আমার খুব ইচ্ছা করে, লাঠিগোছের শক্ত কিছু একটা দিয়ে কয়েকটা ঘা বসাই জায়গামতো। আমার সাথে ন্যা কা মি! আমার চরিত্র নিয়ে বাসায় ঢুকবার সাথে সাথেই বেশ কিছু কথা শুনিয়েছে সে। এখনো মাথায় আগুনের দাপাদাপি থামেনি। 

আমি অবচেতনভাবে নেটে খুঁজি খুন করে লাশ গুম করে ফেলার কার্যকরী উপায়গুলো। কোনোটাই মনে ধরে না। পোহাতে ইচ্ছা করে না এতো ঝক্কিঝামেলা। মা ল টা কে ডি ভো র্স দিয়ে দিলে কেমন হয়? আমি ইভাকে উইল ইউ ম্যারি মি কথাটা লিখে কয়েকটা চুমুর ইমো অ্যাড করছি, এমন সময় সাইড টেবিলে রাখা ফাইলটা চোখে পড়ে। নিতান্ত হেলায় ভরে সেটাকে হাতে নিই। ঠিক মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। একটা কাগজে অনেক কিছুর ফাঁকে স্পষ্ট করে লেখা, শশী সন্তানসম্ভবা। 

আমি মেসেঞ্জারে টেক্সটটা তবু ইভাকে পাঠিয়েই দেই। দেখি না সে কি বলে! 

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই ব্যালকনির দিকে। শশীর বাঁধভাঙা শোকের প্রকোপ কমেছে। ফর্সা পিঠের দু তিন জায়গা লাল হয়ে আছে। ছোটবেলায় শেখা মার্শাল আর্ট এই প্রথম বোধহয় কাজে লাগলো। তবু আমি মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলাম। যাহ্‌… ব্যাপারটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো! 

ও কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি স্যরি বলবো কিনা ভাবছি। এমন সময় ইভা টেক্সটের রিপ্লাই করে। কোনোভাবে ইভা আর শশীর যোগাযোগ হয়েছে। সেই সুযোগে খুব সম্ভবত শশী মা হবার ট্রাম্পকার্ড ছেড়েছে বরকে একান্ত নিজের করে নেবার জন্য। আর ইভা গিল্টি ফিলিং এর দোহাই দিয়ে সম্পর্ক গুটিয়ে নেবার ফাঁকে শেষ লাইনে আমাকে উত্তর দিয়েছে, আমি একজন মোটা দাগের অমানুষ! 

খুব প্রতারিত মনে হয় নিজেকে। অসহায় লাগতে থাকে। নিজে থেকেই শশীর পিঠে কয়েকটা চুমু খাই। হাত ধরে ওকে বেডরুমে নিয়ে আসি। ওর কোমর দু’হাতে জড়িয়ে পেটে কান রেখে কিছু একটা শোনার ভান করে কালক্ষেপন করি। কাঁপা গলায় বলি, আমাকে ক্ষমা করে দিতে। শশী দেখলাম হাসছে। মেয়েটা মা হবার আনন্দে খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেলো নাকি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার অদ্ভুত হাসিটা থামবার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই সাইড টেবিলে চোখ পড়ে আবারো। সেখানে যত্নসহকারে আরেকটা ফাইল রাখা আছে। 

আমি বুঝতে পারি ওটা কীসের আবেদনপত্র। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে আমার। এই মেয়েটার সাথে আমার জীবনের অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠি আমি। শশীর দু পা জড়িয়ে ধরে কাঁদি শিশুর মতো। নিজেই চমকে উঠি, অতোটা বিশুদ্ধ আবেগ ওর জন্য আমার ভেতর এতোদিন লুকিয়ে ছিলো!

লেখক ঃ Taimoor Mahmud Shomik-

বাস্তব অভিজ্ঞতা

 


দিনটা ছিল সোমবার পার্কে বসে আছি হঠাত দেখি একটা মেয়ে এসে পাশে বসলো এবং হাতে থাকা সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিল । আমি বললাম কেন আপনি আমার সিগেরেটটা ফেলে দিলেন??

মেয়েটা কিছু না ভেবেই আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল । আমাকে বলল আপনি তো নিজে সিগেরেট খাচ্ছেনি তার সাথে সাথে পরিবেশের ক্ষতি তো করছেন ই তার সাথে সাথে আপনার বাড়িতে থাকা লোকজনের তিলে তিলে গড়া একটা স্বপ্নকে চুরমার করে ভেঙ্গে দিচ্ছেন । অবাক হয়ে মায়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । মেয়েটার কথা শুনে ভাবলাম ফালতু সিগেরেট খাওয়া ছেড়ে দেব । মেয়েটা উঠে চলে যাচ্ছিল তখনি মেয়েটার হাত ধরলাম এবং বললাম ধন্যবাদ । 

মেয়েটি কিছু না বলে হেসে সেখান থেকে চলে গেল । কিছুদিন ধরে আমি আর ওই পার্কে যেতাম না ।কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর আমি আবারও সেই পার্কে সেই জায়গায় বসে অনলাইন গেম খেলছি । হঠাত দেখি পিছন থেকে কে একটা এসে আমার কাঁধে হাত দিল । পিছন ফিরে দেখি সেই মেয়েটি । মেয়েটাকে দেখে কিছুটা খুশি হলাম আবার কিছুটা অবাকও হলাম । এত দিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখিনি । হঠাতই ভগনবান কেমন আমদের দেখা করিয়ে দিল । কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়েটি এখানে পড়ার তাগিদে এসেছে মা বাবা ভাই এই নিয়ে তার একটা ছোট্ট পরিবার কিন্তু মেয়েটির খুবই কষ্ট কারণ তার বাবা তাকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে পরিক্ষায় ভালো নাম্বার না পেলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে না । সেইজন্য মেয়েটিও দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে ।

মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করাই সে জবাব দিল পীহূ এবং বলল তমার নাম কি ? আমিও নিজের নামে বললাম , টূবাঈ ।                                                                                                                                            মেয়েটি হঠাৎই করে সেখান থেকে উঠে বলল তোমার নাম টা খুব সুন্দর এবং এই কথা বলে চলে গেল । তারপর থেকেই সেই পার্কে  মাঝে মাঝে মেয়েটির সাথে দেখা হয় , এবং আমরা গল্প ও করি । তারপর আস্তে আস্তে আমরা বন্ধুত্ত করলাম , নিজেদের whatsapp number এক্সচেঞ্জ করলাম ।

এখন আমাদের পড়ার চাপ বেড়ে যাওায় আমরা আর পার্কে যাই না । এখন আমাদের whatsapp, messanger এর মাধ্যমে কথাবার্তা হয় । আস্তে আস্তে তার ব্যাপারে সমস্ত কিছু সে আমাকে বলে , আসলে মেয়েটি বড্ড একা । তার এই ব্যাস্ততার শহরে  চেনা বলতে কেউ নেই । মেয়েটিকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলাম মায়ের সাথে পরিচয় করাতে । পিহু আমদের বাড়িতে এসে খুব খুশি হল , মা ও খুব খুশি হল পিহুর সাথে কিছুক্ষন কথা বলে , দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে পিহুকে আবার হোস্টেলে দিয়ে আসলাম ।

ভূতুড়ে গল্প

ভূতুরে মোবাইল চার্জ


শোনা যায় যখন গভির রাত জেগে কোন বাক্তি মোবাইল ব্যবহার করে , তখন সেই বাক্তির পূর্বপুরুষদের আত্মা বা ভুত এসে তাকে পর্যবেক্ষণ করে । আর নিজেরা বলাবলি করে যে সে কি করছে ? আর জিনিস টাই বা কি জেতা এভাবে আল ছড়াচ্ছে ? এছাড়াও আরও আনেক কথায় বলে যেটা জানা যাইনি । এরপর সেই বাক্তি মোবাইল চার্জ এ দিয়ে ঘুমিয়ে পরে । 

তারপর ওই আত্মা বা ভূতেরা ওখানেই থেকে যায় এবং ওই মোবাইল  নিয়ে  ঘাটাঘাটি করে । কিন্তু ভূত যেহেতু সেকেলে তাই তারা পুনরাই মোবাইল চার্জ এ দিতে সক্ষম হয় না  । 

এজন্য প্রায়ই শোনা যায় যে আনেকেই রাতে মোবাইল চার্জ এ বসায় কিন্তু সকালে উঠে দেখে মোবাইল আ চার্জ নেই ।। 

কতোটা ভালোবাসো

কতোটা ভালোবাসো


 দীপান্বিতা-- কতোটা ভালোবাসো বলো দেখি!

তন্ময়-- তোমাকে ভালোবাসার দুঃসাহস আমার নেই। তবে তুমি চাইলে, কোনো এক শীতের রাতে হাতে হাত রেখে হলুদ আলোর ছাওয়ায় অনেকটা পথ হেঁটে যেতে পারি।

দীপান্বিতা-- আর কী পারো?

তন্ময়-- বসন্তের বিকেলে সবুজ পাতার অলংকার গড়ে দিতে পারি। শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে নামলে, ঠিক করে দিতে পারি।

দীপান্বিতা-- আর?

তন্ময়-- মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাইরের বারান্দায় তুমি এসে দাঁড়ালে, তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পাড়ি।

দীপান্বিতা-- কিন্তু, মাঝরাতে ঘুম ভাঙবে কেন? 

তন্ময়-- সবটা কী আর মানুষের নিজের হাতে থাকে গো দীপা! সবার কাছে নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে, শেষ অবধি নিজেকেই নিজের কাছে আড়াল করে ফেলে। তখন তো নিজের শরীরটা অবধি নিজের কথায় চলে না।

দীপান্বিতা-- সে নাহয় তুমি ই ঘুম পাড়িয়ে দিলে।

তন্ময়-- সে পারি। তবে অভিমানে জেগে থাকা জরুরি। ঘুমিয়ে পড়লে ওরা লুকিয়ে পড়ে। পরে সময় মতো রাগ হয়ে বেরিয়ে আসে। আমার উপর রাগ করতে দেবো না তোমায়।

দীপান্বিতা-- কিন্তু এইটুকু তে জীবন চলে না, তা কি বোঝো? বাস্তব না চিনলে ভালোবাসা চলে শুনি। কিন্তু সংসার করা তো সহজ নয়।

তন্ময়-- তবে, আজ থেকে ভালোবাসার দ্বায়িত্ব আমি নিলেম। সংসার এর দ্বায়িত্ব তুমি ই নাও। তারপর সময় করে আমাকেও বাস্তব টুকু চিনিয়ে দিও না হয়।

অতিরিক্ত বাস্তব সচেতন দীপান্বিতার চোখেও নদীর টান আসে। বালির কোনে কোনে জল চিকচিক করে হলুদ আলোয়। তন্ময় ওর চোখ মুছিয়ে দেয়। বাস্তবের শক্ত মেয়েটা ভেজা গলায় বলে, " বাস্তব শিখে কাজ নেই। তুমি শুধু আমার বাস্তব হয়েই থেকো।"

দীপান্বিতা কে কাছে টেনে নিলে তন্ময়। হাতে হাত রাখলে শুনি সাহস বাড়ে। হলুদ আলোয় তন্ময়ের চোখে সাহস ভিড় করে আসে। দীপান্বিতা আজকে একটু ভীতু হয়েই ওর হাত শক্ত করে ধরে থাকে। আবেগ থাকলে কিছু কিছু সময় ভীতু হতেও ভালো লাগে। সাহসী হয়ে সবসময় আবেগ গুলোকে দূরে না রাখলেই হলো। ওরাই যে ভালো থাকতে, ভালো রাখতে শেখায়।।

- অনিবেন্দ্র রায়চৌধুরী

কে বলে আমার সন্তান মানুষ হয়নি - এক মাস্টারমশায়ের গল্প


 

একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার শেষে দেশে ফিরছিলাম। প্লেনে উঠে সুন্দরী এয়ার হোস্টেসের দেখিয়ে দেওয়া সিটে আরাম করে বসলাম। প্রায় পনেরো ঘণ্টার একঘেয়ে ননস্টপ জার্নি। আটলান্টিকের উপর দিয়ে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল কে একপাশে রেখে উড়ে যাবো প্রথমে দুবাই। সেখান থেকে আবার কলকাতায় নিজের দেশে। যদিও এই বিদেশী এয়ারওয়েসের ব্যবস্থা খুব ভাল তবুও এত লম্বা জার্নি করতে ভাল লাগে না আর।

একটা গল্পের বই এর পাতায় চোখ রেখেছিলাম। তখনো টেক-অফ করতে একটু দেরি ছিল। হঠাৎ কানে ভেসে এলো বঙ্গভাষা। যথারীতি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝে নিলাম কথার উৎস স্থল আমার সামনের রো ছেড়ে তার পরের রো। এখান থেকে যেটুকু চোখে পরল এক জোড়া বৃদ্ধ বৃদ্ধা ; একজনের চকচকে টাকের চারপাশে সাদা পাকা চুলের সমারোহ, অন্য আরেক জনের সাদা চুলের খোপার মাঝে কয়েকটা কালো চুল কিছুটা যেন বলছে স্মৃতি টুকু থাক। খুব নিচু স্বরে উত্তপ্ত কিছু আলোচনা হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। এভাবে উঁকিঝুঁকি মারাটা অশোভন, তাই নিজেকে সংযত করে গল্পের বইয়ের পাতায় মন দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু টুকরো টুকরো কয়েকটা শব্দ ভেসে এসে আমার কানে ঢুকছিল, তার মধ্যে আমার জন্মস্থানের নামটা দুবার কানে আসায় কৌতূহল বেড়েই চলল। টয়লেট ঘুরে ফেরার সময় ভাল করে লক্ষ্য করলাম।

বহু বছর পর আমার স্কুলের হেড স‍‍্যার শ্রী শুভময় চ‍‍্যাটার্জীকে দেখে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। ততক্ষণে প্লেন মাঝ আকাশে। ওনাদের পাশের সিটটা খালি দেখে এয়ার হোস্টেস কে বলে ওখানেই বসলাম। আমি বসায় ওনারা চুপ করে গেছিলেন। আমি হাত জোর করে নমস্কার করে বললাম -"স‍‍্যার, আমি নীলাদ্রী ঘোষাল। ৯২ র মাধ্যমিকের ব্যাচ স‍‍্যার, মনে পরছে?"

হাই পাওয়ার লেন্সের ভেতর থেকে দুটো ঘোলাটে চোখ আমার দিকে ফিরে তাকাল। আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠে সারা মুখে সেই সুন্দর হাসি ছড়িয়ে পরল। বললেন - "নীল..... ঘোষাল বাবুর ছেলে!! শুনেছিলাম বড় বিজ্ঞানী হয়েছিস, খুব নাম হয়েছে তোর..."

শেষ কথাটায় কেমন একটা শ্লেষের সুর বেজে উঠলো। মাসিমাকে নমস্কার করে বললাম - "সুজয়দার কাছে এসেছিলেন?"

সুজয়দা হেড স‍‍্যারের একমাত্র ছেলে, আমার থেকে দু বছরের সিনিয়র ছিল। বড় ইঞ্জিনিয়ার, পিটসবার্গে থাকে জানতাম।

মাসিমা মাথা নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে চেয়ে মেঘ দেখতে লাগলেন। স‍‍্যার ও গম্ভীর হয়ে গেছিলেন। বললাম, - "কতদিন ছিলেন ওখানে? কোথায় কোথায় ঘুরলেন স‍‍্যার?"

- "ছিলাম প্রায় দুমাস। ছেলে আর বৌ খুব ব্যস্ত, তাও ঘুরিয়েছে টুকটাক।" স‍‍্যার বললেন।

একবার মনে হল নিজের সিটে ফিরে যাই, ওনারা বোধহয় কথা বলতে চাইছেন না। কিন্তু যেতে গিয়েও পারলাম না। হেডস্যারের কাছে দীর্ঘদিন পড়েছিলাম, খুব কাছ থেকে ওনাকে দেখেছিলাম। উনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। এতো সুন্দর করে সব কিছু বোঝাতেন, পড়ানো ছাড়াও অনেক কিছুই ওনার থেকে শিখেছিলাম। পয়সা নিয়ে প্রাইভেটে উনি কোনোদিন পড়ান নি। তবে আমাদের পাশের চা বাগানের বস্তি গুলোতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বিনা-পয়সায় অনেককে পড়াতেন। এছাড়া বই পত্র দিয়ে গরীব ছাত্রদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। কত গরীব ছাত্রর পরীক্ষার ফি দিয়ে দিতেন প্রতিবছর। 

মাধ্যমিকের আগে বাবার ভীষণ শরীর খারাপ হয়েছিল। বহুদিন বাবা বিছানায় ছিল। জমানো টাকা কড়ি সব শেষের দিকে। আমাদের একটুকরো জমি মা বিক্রি করবে ভেবেছিল সে সময়। কিন্তু স‍‍্যার কোথা থেকে খবর পেয়ে একদিন এসে মাকে বলেছিলেন জমি বিক্রি করতে না।আমার দায়িত্ব উনি নিয়েছিলেন। কয়েক মাস ওনার বাড়ি খাওয়া দাওয়া করে পড়াশোনা করেছিলাম। মাসিমা নিজেদের গরুর দুধ, গাছের ফল , পুকুরের মাছ, লাউ , কুমড়ো শীতের সবজি সব আমার হাত দিয়ে মা কে পাঠাতেন। আমাদের গাছের নারকেল সুপুরি স‍‍্যার নিজে দাঁড়িয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই টাকায় বাবার চিকিৎসা হয়েছিল।

কোনোদিনও কোনো ছাত্রকে বকতে বা শাস্তি দিতে দেখি নি ওনাকে। একবার আমার বন্ধু তরুণ কারো টিফিন চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পরেছিল। তরুণের মা পাঁচ বাড়ি কাজ করে ওকে পড়াতো।ও টিফিন কখনোই আনত না। স‍‍্যার সব জানতে পেরে ওকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়ে ছিলেন। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন দুপুরেই স‍‍্যারের বাড়ি ওকে খেতে ডাকতেন মাসিমা।

মাসিমার ছিল দয়ার শরীর, সব ছাত্রদের মাতৃস্নেহে ভালবাসতেন। আমরা কখনো কোনো কাজে গেলে মাসিমার হাতের নাড়ু , তক্তি খেয়ে আসতাম। সুজয়দা পড়াশোনায় মেধাবী ছিল। অনেক কষ্টে স‍‍্যার ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে ছিলেন। স‍‍্যারের ইচ্ছা ছিল না ও বিদেশে যাক। স‍‍্যার পড়ানোর সময় সর্বদা বলতেন দেশের সব স্কলার ছেলেরা বাইরে চলে গেলে দেশের উন্নতি হবে কি করে? আজ নিজের খুব লজ্জা লাগছিল এই কথাটা মনে পরায়। আমিও বহু বছর বাড়ির বাইরে, যদিও দেশের মাটিতে বসেই আমি গবেষণা করছি।

আমিও স‍‍্যারের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ডাক্তারি পাস করে প্রথম কিছুদিন এক গ্রামীণ হাসপাতালে ছিলাম। রাজনৈতিক পার্টির দাপটে আর রুগীদের আত্মীয় দের অত্যাচারে সব নীতি বিসর্জন দিয়ে কয়েক মাসেই পালিয়ে এসেছিলাম। তারপর পড়তে বাইরে এসে গবেষণায় ঢুকে গেছিলাম। বিদেশে কাটিয়েছি বহু বছর। বাবা মা বহুবার ফিরতে বললেও ফিরতে পারি নি। অবশেষে বাবা মারা যেতে ফিরে এসেছিলাম।তারপর গবেষণার জন্য ব‍‍্যঙ্গালোরে চলে যাই। গত পাঁচ বছর ব‍‍্যঙ্গালোরেই আছি। 

একটা এয়ার বাম্পে পরে প্লেনটা লাফিয়ে ওঠায় সম্বিত ফিরল। দেখলাম স‍‍্যার একটা বই পড়ছেন। এয়ার হোষ্টেস সবাইকে খাবার দিচ্ছিলেন। ওনারা নিরামিষ খাবার নিলেন। স‍‍্যার আমায় জিজ্ঞেস করলেন - "তোর ফ‍‍্যামেলি কোথায়? একা যাচ্ছিস !!"

আবার একটা ধাক্কা, ঝনক আমাকে ছেড়ে চলে গেছির দশ বছর আগেই। আসলে বিদেশে এসে আমার কাজের চাপ এতো বেশি ছিল ওকে সময় দিতে পারতাম না। ওর কোনো বন্ধু ছিল না। একা কোথাও যেতে পারতো না। অবসাদে ভুগে ভুগে শেষ হয়ে যাচ্ছিল ও। দশ বছর আগে ফিরে গেছিল একাই। যদিও ডিভোর্স হয় নি কিন্তু যোগাযোগ ছিল না বহু বছর। ও ওর বাবা মা এর কাছেই থাকত। দেশে ফিরে ফোনে কয়েকবার কথা হয়েছিল। একবার দেখা করেছিলাম। স‍‍্যারকে অর্ধসত্য বললাম যে ও দেশেই আছে।

মাসিমা বললেন - "বাঃ, ভাল, তোমার মা অন্তত বৌ নাতি নাতনি নিয়ে আনন্দে আছেন তাহলে।" লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না।

মাসিমা বলে চলেছিলেন - "আমার ছেলেটা কি করে এতো বদলে গেল জানি না। আমাদের বোধহয় কোথাও কোনো ফাঁক ছিল।" ওনার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরল।

- "আঃ, কি হচ্ছে!! নিজেকে সামলাও।"  স‍‍্যার একটা চাপা ধমক দিলেন যেটা ওনার চরিত্রের সাথে বেমানান। 

- "কেন চুপ করবো? এভাবে ফিরে যাচ্ছি..... ওখানে গিয়ে সবাইকে কি বলবো বল তো? জমি বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়ে এলে তুমি ...."

- "সে কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। আগে তো পৌঁছাই।" স‍‍্যার উত্তর দিলেন।

বুঝতে পারছিলাম কোথাও তাল কেটে গেছে। বললাম - "স‍‍্যার, আমি আপনার ছেলের মতো। আমাকে খুলে বলবেন কি হয়েছে? যদি আমি কিছু করতে পারি ........"

- "সবে চার ঘণ্টা কেটেছে। এখনো ১১ ঘণ্টার পথ বাকি। তুই দেশে ফেরার আগেই সব জেনে যাবি।" স‍‍্যার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।

-  "সুজয় আর ওর বৌ বহু বছর বিদেশে। বহু বছর পর এ বছর সুজয়ের ছেলে হয়েছিল, বহুদিন ওরা দেশে আসে না। সুজয় আমাদের পাকাপাকি ওর কাছে চলে আসতে বলেছিল অনেক দিন ধরেই। ওরা ওদেশের গ্রীনকার্ড পেয়ে গেছিল। এতদিন আসি নি। কিন্তু নাতির ফটো দেখে তোর মাসিমাকে আর রাখতে পারলাম না। সুজয় চাইছিল আমরা পাকাপাকি ভাবে চলে যাই। ও নিজে এসে সব ব্যবস্থা করে জমি বাড়ি সব বিক্রি করে আমাদের নিয়ে গেছির দু মাস আগে। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এই বেকার বৃদ্ধর কথায় কেউ কান দেয় নি। এখানে এসেই বুঝলাম ওদের আসলে বাচ্চা দেখার জন্য আয়ার দরকার ছিল। ক্রেস গুলো ছমাসের আগে বাচ্চা নেবে না। বৌমা বাধ্য হয়ে আমাদের আনিয়েছিল। বাচ্চার ছমাস হতেই ওকে ক্রেসে দিয়ে আমাদের ফেরার টিকিট ধরিয়ে দিল ছেলে। বলল শীত আসছে, আমাদের কষ্ট হবে ঠাণ্ডায়। কোনও বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে নেট ঘেঁটে।" স‍‍্যার এটুকু বলেই চোখ বুঝলেন।

- "বাচ্চাটা এই দুমাসেই আমাদের ন্যাওটা হয়ে গেছিল। খুব মুখ চিনত। দেখলেই দু হাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চাইত।" মাসিমা কান্না ভেজা গলায় বললেন।

- "জমি বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছি। টাকা পয়সা সব নাতির নামে করে দিয়েছিলাম। আমাদের আর কি প্রয়োজন!! কিন্তু এখন ভাবছি কি করবো!!" স‍‍্যার বললেন।

সুজয়দাকে যতটুকু দেখেছিলাম পড়াশোনা ছাড়া কিছুই জানত না। আজ নিজের বাবা মা কে এভাবে অবহেলা করেছে শুনে খুব রাগ হল। আমাদের পাশের বাড়ির নগেন জেঠুর ছেলে কলকাতায় ভাল চাকরী করতো। বাবা মা কে সেভাবে দেখত না। বহু পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ি ভেঙ্গে পরছিল। মেরামতের দরকার ছিল। ওনাদের ও চিকিৎসার দরকার ছিল। স‍‍্যার স্কুলের সব ছাত্রদের নিয়ে নিজেই ওনাদের বাড়ি মেরামত করে দিয়েছিলেন। চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। এমনি টুকরো টুকরো বহু কথা মনে পরছিল।

আলম বলে একটা মুসলিম ছেলে পড়তো আমাদের সাথে। ওর বাবা ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পরে গুলি লেগে মারা গেছিল। সবাই ওকে একঘরে করেছিল ডাকাতের ছেলে বলে। একমাত্র স‍‍্যার আমাদের বুঝিয়ে বলেছিলেন কেউ শখ করে ডাকাত হয় না। আর ওতে আলমের কোনো দোষ নেই তাও বলেছিলেন। সস্নেহে আলমের চোখের জল মুছিয়ে ওকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সেই আলম আজ একটা এনজিও চালায়। বন্ধ চা বাগানের পরিবার গুলোকে সাহায্য করে নানা ভাবে। সেদিন স‍‍্যার ওর পাশে না দাঁড়ালে ভেসে যেতো ও। হয়তো বাবার থেকেও বড় ডাকাত তৈরি হত একদিন।

আমাদের উত্তরবঙ্গে বর্ষা কালে পাহাড়ি নদীতে খুব হড়কা বান আসতো। সেবার নাগরাকাটা টাউনটা রাতারাতি ভেসে গেছিল ডায়না নদীর জলে। কত লোক যে গৃহহারা হয়েছিল হিসাব নেই। গরমের ছুটি চলছিল স্কুলে। হেডস্যার একাই নেমে পরেছিলেন সাহায্য করতে। স্কুলে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল গৃহহারা পরিবার গুলোকে। আমদের কয়েকজনকে নিয়ে স‍‍্যার একাই ঐ বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে সাহায্য তুলে ওদের কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া শুকনো জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। সরকারী সাহায্য এসেছিল বেশ কিছুদিন পরে। সে বছর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন স‍‍্যার। আজ ওনার ছেলের কৃপায় ওনার ঠিকানা হতে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম। মনটা খচখচ করছিল।

দুবাইতে নেমে স‍‍্যার আর মাসিমাকে বসিয়ে চটপট কয়েকটা দরকারি কাজ করে নিলাম। মেল পাঠানোর ছিল কয়েকটা। এতো বড় জার্নি তে মাসিমার শরীরটা একটু খারাপ করেছিল। তিনঘণ্টা পর কলকাতার ফ্লাইটে উঠে আমার সিটটা বদলে ওনাদের কাছেই বসেছিলাম। স‍‍্যার বললেন - "একটা উপকার করবি নীল, তত্কালে আমাদের উত্তরবঙ্গে যাওয়ার টিকিট করে দিতে পারবি? ওখানেই সারা জীবন কাটিয়েছি। ওখানেই শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই। তোর মাসিমারও তাই ইচ্ছা। ঐ বৃদ্ধাশ্রম কে না বলে দেবো। যে কটা টাকা পেনসিয়ান পাই তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে। একটা এক-কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে নেবো।"

এবার আমার চোখের কোন ভিজে উঠেছিল। বললাম - "আপাতত আমার উপর সব ছেড়ে দিন। ব্যবস্থা করছি।"

দমদম এয়ার পোর্টে লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম ওনাদের নিয়ে। নেট ওয়ার্ক আসতেই কয়েকটা দরকারি ফোন করে নিলাম। বাইরে আসতেই চোখে পরল স‍‍্যারেদের নাম লেখা একটা বোর্ড হাতে বৃদ্ধাশ্রমের লোক দাঁড়িয়ে। কত আধুনিক ব্যবস্থা করেছে সুজয়দা!!

ওনাদের নিয়ে বাইরে এসে দেখলাম কাজল, অনীশ, রাহুল , তরুণ, প্রতিকদা সবাই ওয়েট করছে। সবাই ছুটে এসে স‍‍্যারের ট্রলিটা টেনে নিলো। আমি পরিচয় করালাম স‍‍্যারের সাথে ওনার সব প্রাক্তন ছাত্রদের, আজ সবাই নিজের নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আমার মেল পেয়ে সবাই আজ ছুটে এসেছে স‍‍্যারের জন্য। আলম ও কলকাতায় এসেছিল কোনো কাজে। কিছুক্ষণের মধ্যে ও এসে গেলো। রাহুলের ফ্ল্যাট বাগুইহাটিতে, ওখানে সবাই মিলে স‍‍্যার আর মাসিমাকে নিয়ে গেলাম। আলম জানালো সে স‍‍্যারদের নিয়ে যেতে চায়। ওদের এনজিও একটা অনাথ আশ্রম খুলেছে ওখানেই। স‍‍্যার কে ওখানেই রাখতে চায় ও। এভাবেই শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে চায় আমাদের হেড স‍‍্যার কে।বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের মাঝে স‍‍্যার খুব ভাল থাকবেন ওর ধারনা। যে কাজ সারা জীবন করেছেন তাই নিয়েই থাকবেন। স‍‍্যার আর মাসিমা রাজি হলেন অবশেষে। 

স‍‍্যার মাসিমাকে বললেন - "কে বলে আমার সন্তান মানুষ হয়নি। এরাও তো আমার ছেলে। আজ কেমন সবাই আমাদের আপন করে নিলো"। স‍‍্যারের চোখে আনন্দের অশ্রু।

সমাপ্ত।

রূপকথা

Bengali Story - Bangla Short Story
রাত তখন ১১টা, শুনশান গলি .. । 
অফিস ফেরত মেয়েটি অন্ধকার গলিতে পা বাড়াল, এ গলি পেরিয়ে ডান দিকে দুটো গলি ছাড়িয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে তার বাড়ি । চুপচাপ, শুনশান চারদিক .. এইখানেই তো গলির দক্ষিণ কোনায় কতগুলো ছেলে রোজ আড্ডা মারে! তাহলে? .. সে এগোতে লাগল .. পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ সারা এলাকা যেন শুনতে পাচ্ছে .. হঠাৎ... 
..
.
নাহ! মশাই ! হঠাৎ কিছুই নয়, আপনি যা ভাবছেন তা একদম নয়! মেয়েটি বাড়ি পৌঁছাল। 
মা বলল " কি রে মা! আজকেও এত দেরী করলি কেন, খাবার যে ঠান্ডা হয়ে গেল, আপিসে কাজের চাপ বেড়েছে?" ..
- আরে কি বলছো? রোজই তো এরকম সময়েই ফিরি, খেতে দাও তো! অত ভাবো কেন? "মেয়েমানুষ" হয়েছি কি করতে? 
..
মেয়েটি খাওয়া সেরে ঘরে টিভি চালিয়ে .. ফ্যানের তলায় সোফায় গা এলিয়ে দিল ..। উফঃ এই সরকারি চাকুরি! কি ঝক্কির বাবা! আজকাল তো মেয়েরা সরকারি চাকরি না করলে বিয়ের জন্যে ছেলেই পাওয়া যাচ্ছে না! ... তাই কোন গতি না দেখে.. মা-বাবার অনুরোধে .. ইয়ে আর কি! 
..
টিভিতে একটা নিউজ চ্যানেল দিয়ে সে মৌরি চিবোতে চিবোতে সেদিকে মনঃসংযোগ করল, কাল ১৫ই আগস্ট ছিল, ভারতের ৭২তম স্বাধীনতা দিবস, তাই বর্তমান প্রগতিশীল ভারতের কিছু ভালো ভালো খবর পরিবেশন করা হচ্ছিল .. মেয়েটি মন দিয়ে দেখতে লাগল ..
- " বর্তমানে ভারতে অর্থনৈতিক উন্নতির বিচারে চিনকেও পিছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বর প্রগতিশালী দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে, ঘুষ, দুর্নীতি ,করফাকি, ট্রেনের টিকিট না কাটা বা অরাজনৈতিকতা দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হয়েছে, সমগ্র রাজনৈতিক দলগুলি দেশের স্বার্থে একত্রিত হয়ে একটি মাত্র দল গঠন করেছে, বিগত ২০ বছরে ভারতে একটিও ধর্ষণ ,নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম কন্যাভ্রূণ হত্যার নিদর্শন মেলেনি, আজকাল সারা ভারতে ক্রাইমের percentage মাত্র ০.৫%, আজকাল পুলিশের সেরকম প্রয়োজনীয়তা পরছে না, শিল্প, গবেষণা, আর্ট, বিজ্ঞানে ভারত প্রভূত উন্নতি করেছে, সারা ভারতে বেকারের সংখ্যা বিলুপ্ত প্রায়, কেউ আর বেকারত্বের জ্বালায় বিগত ২০বছরে আত্মহত্যা করেনি, কোন খুব প্রতিভাশালী ব্যক্তিও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে না, দেশের infrastructure এ একরকম নবজাগরণ আসায় ভারত সারাবিশ্ব থেকে সমাদৃত হচ্ছে, কৃষিবিদ্যায় নতুন টেকনোলজির ব্যবহারে বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, কোন চাষি বিগত ২০ বছরে অনাহারে থেকে আত্মহত্যা করেনি, ধর্ম-জাতি-বর্ন সব মিলেমিশে একাকার হয়েছে,সামাজিক ও শিক্ষা, ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সংরক্ষন প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কারন অনগ্রসর জাতি আর অনগ্রসর নেই, সবাই সমান ।আজ খুব গর্বের দিন , শুভ স্বাধীনতা দিবস, সবাই এগিয়ে আসুন, আমরা ভারতকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাই ।"
- মেয়েটি টিভি বন্ধ করে ভাবতে শুরু করল ... কি অদ্ভুত আমাদের ভারতবর্ষ! অনেক ভাগ্য করে জন্মেছিলাম! কোন পারিবারিক চাপ নেই, প্রেমিকযুগল যে কেউ যে কাউকে বিয়ে করতে পারে, কোন ধর্ম-জাতি-বর্ন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না .. 
কেউ আর কার্টুন আকার জন্যে জেলে পুরে দেয় না, গণতন্ত্রের মুখ চেপে ধরে না, প্রত্যেকটি মানুষের সমান অধিকার, তুমি এটা খাবেনা, এটা বলবে না,এটা পরবে না, এটা করবে না, ওটা করবে না, কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, এখন তো ভারতে ৯৫% মানুষ শিক্ষিত, আর দারিদ্রসীমার নীচে মাত্র ২% মানুষ, প্রত্যেকটি মানুষ, সৎ, দেশপ্রেমী, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান... একে অপরের সাহায্যে সর্বদা সক্রিয়। এ তো ভারতবর্ষে নয় যেন স্বর্গভূমি, একদিন সারাবিশ্বে স্বাধীনতার আক্ষরিক মানেই হয়তো ভারতবর্ষকে বোঝানো হবে ।
..
রাতে কখন যে ঘুম এসে গেছিল ... কে জানে! মেয়েটি সকালে উঠে তড়িঘড়ি অফিস ছুটল ... বাস স্ট্যান্ডে এসে চারপাশের পরিপাটি গোছানো চারপাশের পরিবেশটা তাকে প্রতিদিনের মতোই মুগ্ধ করল, চারদিকে গাছপালা ,চকচকে রাস্তা,কোথাও কোন নোংরা-আবর্জনা নেই... রাস্তার কোনায় ডাস্টবিনে মেয়েটি সদ্য শেষ হওয়া চিপসের প্যাকেটটি ফেলে এল ...হঠাৎ কোথা থেকে একটি লোক দৌঁড়তে দৌঁড়তে এসে ডাস্টবিনে ...."পিক!" 
মেয়েটির দিকে লজ্জাতুর মুখে তাকিয়ে বলল "অনেকক্ষন ধরে মুখে জমে ছিল দিদিভাই,সেই কখন থেকে চিবোচ্চি, আর রাখতে পারছিলাম না,"
- মেয়েটি হেসে ফেলল ।
...
উপরের সবকিছু কেমন রূপকথার মতো লাগল তাই না? কিন্তু এই রূপকথাটাই বাস্তব হতে পারত যদি আমরা প্রত্যেকটি ভারতবাসী এরকম হতে পারতাম, সৎ, দায়িত্বশীল, কর্মঠ,দেশপ্রেমী ভারতীয় নাগরিক হতাম. ... আমাদের প্রচেষ্টাতেই এই রূপকথার মতো কথাগুলি বাস্তবায়িত হতে পারত । হ্যা! আমাদের ভারতবর্ষও স্বর্গ হতে পারত... কিন্তু।