আমি সুমন - ১


আমি সুমন - ১

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমি জানি ভিনি আমাকে ভালবাসে।
ভালবাসে বলেই ভিনি বার বার আমার কাছে ধরা পড়ে যায়;
নাকি ইচ্ছে করেই ধরা দেয় কে জানে।
তার সাথে প্রথম দেখা সেই শিশু বয়সে।
তখন ও ফ্রক পরে, লালচে আভার এক ঢল চুল আর ঠোঁটের উপর বা ধারে একটা আঁচিল,
খুব ফরসা রঙ- ব্যাস আর কিছু মনে নেই।
প্রথম দিন, পনেরো ষোলো বছর পর প্রথম দিন ভিনি আমার দিকে তাকালই না।
কিংবা এক পলকেই সব দেখে এবং জেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ভালমানুষ সেজে গেল নিজের মার সামনে, কে জানে।
বসল খাটের উপর জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।
সুমন, এই হচ্ছে ভিনি।
ওর মা বললেন, তার চোখমুখে অহংকার ঝলমল করছিল,
আরো অনেক নিঃশব্দ কথা ছিল তার মুখে জা তিনি বললেন না,
আমি বুঝে নিলুম- দেখো ত' আমার ভিনি কি সুন্দর হয়েছে।
দেখো ওর আঙুল, ওর চুল, ওর মুখের ছাঁদ,
কথা বলে দেখো কি সুন্দর মিষ্টি ওর গলার স্বর, রাজপুত্রের যুগ্যি আমার ভিনি।
এইসব কথা ভিনির মায়ের মুখে লেখা ছিল কিংবা বলা ছিল। আমি বুঝে নিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছিল আমার। আমি তেমন কিছু হলুম না কেন।
ভিনির বয়স হয়েছে বিয়ের, তবু কোনদিন ওর অভিভাবকেরা আমার কথা ভাবেন না-
আমি বুঝে গেলুম প্রথম দিনের প্রথম কয়েক মিনিটেই।
মনে মনে বললুম- পালা সুমন, মনে মনে যোগী ঋষি হয়ে যা।
ছেলেবেলায় তুই যে সুন্দর ছিলি একথা অনেকেই ভুলে গেছে।
এখন কাঠুরের মত চেহেরা তোর, গুণ্ডাদের মতো ছোট করে ছাটা চুল,
মুখের ভাব চোর চোর, কাঠ হয়ে বসে আছিস।
কতদিন দেখা নেই! ভিনির মা বলে- কি করে আমাদের ঠিকানা পেলে?
সেটা আমার গুপ্ত কথা। তাই বললুম না, হেসে এড়িয়ে গেলুম।
বুঝলুম ভিনি যে আমাকে তিনটে চিঠি লিখেছিল পর পর তার কথা ওর বাড়ির কেউ জানেনা।
তার প্রতিটিতেই লেখা ছিল- একবার আসবেন।
আপনাকে বড় দরকার আমার।
আমারও প্রশ্ন- আমার ঠিকানা ভিনি পেল কোথায়!
দরকারটা আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেননা ভিনি জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে ছিল।
অথচ পনেরো- ষোল বছর পর দেখা, তারও আগে দরকারের চিঠি দেওয়া।
চা খেয়ে আমি উঠে পড়লুম- চলি।
আবার আসবে তো? ভিনির মা বলল- আমরা আর তিন চার মাস কলকাতায় আছি।
উনি রিটায়ার করলেন, হেতমপুরে ওঁদের দেশেই আমাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে,
দু'তিনটে ঘরের ছাদ বাকি, ছাদ হলেই আমরা চলে যাবো।
এর মধ্যেই এসো আবার। মা বাবা কেমন? বলে হাসলেন- কতদিন ওঁদের দেখি না।
হ্যাঁ বলেই বেরিয়ে আসছিলুম,
মনে মনে তাগাদা দিচ্ছিলুম নিজেকে- পালা সুমন, ভিতুর ডিম, আর আসিস না কখনো।
সিঁড়িতে পা যখন দিয়েছি তখনই গলার স্বর শুনলুম- আমি অহংকারী নই।
এক ঝলক ফিরে দেখলুম- পিছনে সেই লালচে চুলের ঢল, আধো আলোতেও ঝলমল করছে মুখ।
একটু শুকনো ভাব আর জোর করা হাঁসি।
পালালুম।

ধন্যবাদ
পার্ট ২ অবশ্যই পড়বেন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন