মাতৃ দিবস - একটা অসাধারন গল্প

স্বার্থ লুকিয়ে থাকে সকল সম্পর্কের মধ্যে মাতৃ দিবস

-হ্যাঁ রে, দিনে কত টাকা দেয় তোর মালিক? 
- পাঁচশো টাকা মা।
- এ-ত। তা ক'টা সিঙাড়া গড়িস?
- হাজার দুয়েক। জানো মা, আমি না আজকাল টিভির দিকে তাকিয়েও সিঙাড়া গড়তে পারি।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ গো মা। এই দু' বছরে অভ্যেস হয়ে গেছে।

তেরো বছরের কানুর এ এক বড় গর্ব। মায়ের কোলের কাছে ঘেঁষে স্বপ্ন দেখে, অভাবী সংসারের হাত থেকে সে বাঁচাবে তার মাকে। বড় করবে ভাইদের। নিজের একটা সিঙাড়ার দোকান হবে....

-তা বাড়িতে যখন এসেছিস ভাইবোনদের জন্য একদিন বানা না। দেখি আমার বড় ছেলের হাতের সিঙাড়া কেমন? তোর বাবাও খুব খুশি হবেন।
আনন্দে চকচক করে কানুর চোখ। বাবা খুশি হবে? বেশ কালই হবে। খুব ভাল করে বানাব মা।
কানুর বাবা চোখে বিশেষ দ্যাখেন না। কারখানার আগুন ছিটকে চোখে লেগে সেই যে দু বছর আগে শয্যা নিয়েছেন, আজও সেভাবেই পড়ে। একটা চোখ যাওয়ার পর থেকে মনটাও খান খান হয়ে গেছে। সেই বাবা...
-মা, ময়দা-টয়দা আমিই কিনে আনব। তুমি শুধু আলু-টালুগুলো কেটে দিও।
-ঠিক আছে।
-মা, একটু নারকোল কোরা দেব? বেশ লাগবে খেতে।
-না। না। নারকোলের অনেক দাম। দরকার নেই।
সিঙাড়া, তার আনুষঙ্গিক...দোকানের গল্প, মালিকের গল্প... মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কানু। মায়ের কাপড়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ। অনেকবার ভেবেছে মার একটা না-কাচা কাপড় সে নিয়ে যাবে দোকানে।

বড়বাজার অঞ্চলের দোকানঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে, ভোর চারটেতে ঘুম ভেঙে যাবেই যাবে। কী আশ্চর্য সেই চারটেতেই উঠে পড়ে কানু! কী করবে। সবাই ঘুমোচ্ছে। পা টিপে টিপে বেরোয়। উঠোনে এসে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘলা। বৃষ্টি হবে বোধহয়। 
নাহ্। উনুনটা ধরিয়ে রাখি। মা খুব খুশি হবে। কয়লা-কাঠ জড়ো করে উনুন ধরায় কানু। আস্তে আস্তে উনুনে আঁচ ওঠে। কানু তাতে ভাতের জল চাপায় হাঁড়িতে। ইস্ টাকা জমিয়ে যদি মাকে একটা গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
-তুই ওখানে কী করছিস কানু? ও মা! উনুন ধরিয়ে ফেললি? সোনা ছেলে রে আমার! 
তার পর চেঁচিয়ে অন্য ভাইদের উদ্দেশে বলে, হ্যাঁ রে তোরা দেখে যা ছেলে আমার কেমন উনুন ধরিয়ে দিয়েছে। তোমরা তো হাত পা নেড়েও বসো না।
মায়ের চেঁচামেচিতে জেগে উঠোনে চলে আসে বাকি চার ভাই। তার পর এত সামান্য ব্যাপার দেখে ওরা আবার ঘুমোতে চলে যায়।
-মা, বলো না কী সাহায্য করব তোমাকে?
- দু বালতি জল এনে দিবি সোনা?
এক ছুটে দুটো বালতি হাতে বেরিয়ে পড়ে কানু।
লাফাতে লাফাতে তেরো বছরের আনন্দে উচ্ছ্বল ছেলেটা জল আনতে যায়। ভাবে পুজোয় যখন আসবে তখন একটা চাকাওয়ালা ড্রাম বানিয়ে নিয়ে আসবে মালিককে বলে। মালিকরা দোকানে ওই ভাবেই জল আনায়। আর পুজোর ছুটিতে তিন দিন নয়, এ বার দশ দিন থাকবে মার কাছে। ভাইদের সঙ্গে খেলবে। কিন্তু পুজোয় কাজ করলে তো ডবল টাকা দেয়। দৃর। দরকার নেই। পুজোর সময় মা-কে ছাড়া ও থাকতে পারবে না।

ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে কানু। দু' হাতে দু বালতি জল।
-আয় আয় কানু। নে, আলু আমি কেটে রেখেছি। তুই ময়দাটা নিয়ে আয়।
বালতি রেখে আবার ময়দা আনতে ছোটে কানু। কী আনন্দ! আজ সবাইকে প্রাণ ভরে খাওয়াবে সে।
বাড়ি ফিরে বড় গামলায় ময়দা মাখতে বসে। একে একে ভাইরা এসে কানুর এই কাজ দেখে যায়। 
-তোমাদের দ্বারা কিস্যু হবে না। যাও পড়তে বসো। দ্যাখো যদি পাস করতে পারো। অন্য ভাইদের মুখ ঝামটা দেয় মা। 
কানু মনে মনে এত খুশি হয়! মা তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি 'আপন' হয়। তার ওপরেই সবচেয়ে ভরসা। চোখে জল আসে কানুর। এ বার মাত্র দুদিন ছুটি নিয়ে এসেছে। পুজোয় দশ দিন নেবেই সে।
-হ্যাঁ রে বেলা যে বয়ে যায়। তোদের হল?
-এই আর একটু বাবা। তাড়াতাড়ি করে বাকিগুলোও গড়ে নেয় সে। তার পর উনুনে কড়াই বসায়। তেল ঢালে। 
-মা। এ বার তুমি এ গুলো ভেজে দাও। আমি ভাজতে পারি না। জানো ভাজতে পারলে আরও আট আনা করে বেশি পেতাম। কিন্তু মালিক আমাকে ভাজতে দেয় না। বলে ছোট ছেলে হাত পুড়ে যাবে।
-দূর। কেন পারবি না। আমার কোলে বোস, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।
-না মা, আমার ভয় করে। থাক।
-দূর পাগল। ভয় কী রে। আয় না। আমি শেখাচ্ছি।
প্রায় জোর করেই শিখিয়ে দেয় গরম তেলে কী করে ছাড়বে। ছেঁকে তুলবে। "আট আনা ছাড়বি কেন!"
মা কানুর গলা জড়িয়ে বলে এই ছেলেটাই আমাকে ভালবাসে। কানু মায়ের বুকে মুখ গুঁজে জড়িয়ে ধরে। 
-মা এ বার পুজোয় তোমার কাছে দশ দিন এসে থাকব জানো। আবেশে বুজে আসে কানুর চোখ। 
-সে কী রে, তুই যে বললি পুজোর সময় ডবল মাইনে?
-মা।
-বোকা ছেলে। কেউ এ সুযোগ হারায়। তুই দশমীর দিন আয়।
-ও দিন তো মায়ের ভাসান।
-তাতে কী।
-মা।
-সোনা। তুই তো ভাইদের মতো অবুঝ নয়। তোর ওপরেই তো জোর করতে পারি বল। পুজোয় আসিস না বাবা। ওই টাকাটায় ভাইদের পরীক্ষার ফিজ জমা করতে হবে।
এতক্ষণে মায়ের বুকের মধ্যে থেকে মাথা তোলে কানু। যার ভাল নাম কর্ণ। এ যুগের কর্ণও বলা যায়। 
তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আবেশ।
-বোকা ছেলে। কাঁদছিস কেন। দশমীর দিন আসবি। খুব গল্প করব দুজনে।
-তাই হবে মা। ভাইদের সঙ্গে আমার কোনও দিনই আর খেলা হবে না।
চোখের জল মুছে মা-ও দ্রুত বাড়ির ভিতরে চলে যায়। দূরের ঘর থেকে ভেসে আসে খরখরে এক স্বর। 
-কী রে কর্ণ, ও কানু তোদের হল? আমার তো খিদেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে।

 -Somdutta Chakraborty

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন