সেই ছেলেটা


 চেম্বার থেকে বেরিয়েই দেখি, আবহাওয়ার বেহাল অবস্থা l কৃষ্ণমেঘের চাদরে পুরো আকাশটা ঢেকে গেছে l বুঝলাম, কপালে দুর্ভোগ আছে l মনে মনে, খুব রাগ হল, আজকেই আমার প্রাইভেট কারটাকে  খারাপ হতে হল l চেম্বারে আসার সময় একটা আন্দাজ করেছিলাম , প্রকৃতির মেজাজ ক্ষিপ্ত আছে, কিন্তু এতটাও খারাপ হবে, ভাবিনি l যাই হোক, এখন আমাকে বিষ্ণুপুর থেকে যেতে হবে চাকদহ স্টেশনে, সেখান থেকে কল্যাণী l বাসে উঠেই জানলার ধারে সিট পেয়ে গেলাম l বেশ লাগছিলো, ঠান্ডা হওয়ার স্পর্শ সারাদিনের  ক্লান্তি ঘুচিয়ে দিলো, বহুদিন এমন শান্তি পাইনি,এমন শান্তি শুধু মায়ের কোলেই পাওয়া যায় l

 চাকদহ বাসস্ট্যান্ডে বাস থামলো l নেমে দেখলাম, আকাশের আরও অবনতি ঘটেছে l ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে l এখন আর সেই সাময়িক আরাম, আমার মনে  শান্তি দিচ্ছেনা, বরং চিন্তা হতে লাগলো যে, কী করে বাড়ি পৌঁছবো l  ভাবতে ভাবতে স্টেশনে চলে এলাম l স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম, স্টেশনে লোক সংখ্যা হাতে গুনে বলা যাবে l স্টেশনের উপরে সব দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে l হবেই তো, অনেক রাত যে হলো l শুধু সুবলদার চায়ের দোকানটা খোলা ছিল l  সুবলদার সঙ্গে আমার বহুদিনের আলাপ l আমি যখন প্রথম প্রথম চাকদায় আসতাম, ট্রেনেই আসতাম, তখন ওনার দোকানের চা খেতাম l ভারী ভালো মানুষ, সরল মানুষ l সুবলদাও দোকানের ঝাঁপি নামিয়ে আমায় দেখে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন : আরে! ডাক্তার বাবু! অনেকদিন পর! তা হঠাৎ স্টেশনে! কী ব্যাপার?'

আমি : ' আর বলবেননা দাদা! আমার প্রাইভেট কার খারাপ হয়ে গেছে l তাই ট্রেনে করে কল্যাণী যাব l কখন ট্রেন আছে দাদা?'

সুবলদা  : 'আরে ডাক্তারবাবু, আজ রাতে এদিকের সব ট্রেন বাতিল l কদিন ধরে যা বৃষ্টি হয়েছে,এদিকের লাইনে জল জমে গেছে l কাল ভোর ৫টার আগে ট্রেন নেই l আপনি বরং  আজকের রাতটা ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে দিন l একটু সামনে এগিয়ে যান, একটা তরকা রুটির দোকান এখনও খোলা পাবেন l খেয়ে নেবেন l ওয়েটিং রুমে আপনার আশা করি অসুবিধা হবেনা l একটা রাত একটু কষ্ট করুন l ভোর ৫টায় ট্রেন পেয়ে যাবেন l'

সুবল দা ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেলেন l যা ভেবেছিলাম তাই হলো, দুর্ভোগের সূচনা হয়ে গেল l  সামনের দোকান থেকে রুটি আর তরকা কিনে খেয়ে, ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলাম l হঠাৎ দেখি আমার ফোনটা বেজে উঠলো l ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো 'জয়দীপ ইস কলিং ' l জয়দীপ, আমার ছোটবেলার বন্ধু, পেশায় উকিল, ওই আমার কেসটা নেবে l ফোনটা রিসিভ করেই বললাম : '   বল জয়দীপ l'

ফোনের ওপাশ থেকে জয়দীপের গম্ভীর কণ্ঠস্বর : ' শোন মৃদুল,  এই রবিবার তু্ই কিন্তু আমার বাড়িতে আসিস l আমি বাড়িতে থাকবো l'

আমি : ' হ্যাঁ অবশ্যই যাব l তোর সাথে অনেক কথাও আছে l'

জয়দীপ  : 'তু্ই কী সিরিয়াস? আমি আবার বলছি, কোনো ডিসিশন নেওয়ার আগে বারবার ভেবে দেখ l'

আমার গলা ভারী হয়ে এলো l আমি মনে শক্তি সঞ্চয় করেই বললাম : 'ইয়েস, আই অ্যাম সিরিয়াস l এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই l শোন আমি রাস্তায় l তোকে বাড়ি পৌঁছে ফোন করছি l'

ফোনটা রাখার পর, মনের মধ্যে হাজার হাজার স্মৃতি ভিড় করলো l মল্লিকার সাথে আমার প্রথম দেখা, এক সাথে কত স্বপ্নের মায়াজাল বোনা, কতো কমিটমেন্ট, কতো সুন্দর মুহূর্ত, কখনো ভাবিনি, এমন দিন আসবে l কিন্তু সুখস্মৃতির পর্দা নিমেষে ছিঁড়ে পরক্ষনেই উপচে পড়ল, তিক্ত স্মৃতির বিষক্রিয়া l একে অপরের প্রতি শুধু অভিযোগ, দোষারোপ l না ও আমায় বুঝেছে, না আমি ওকে l শুধু না পাওয়া, অভিমান, অভিযোগের পাহাড়ে অশান্তি আর অশান্তি l অসহ্য, তার থেকে দুজনে দুজনের মতো শান্তিতে থাকাই শ্রেয় l চিন্তা করতে করতে আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা হতে লাগলো, আমি চোখ বুজে ফেললাম l চোখের সামনে ভেসে এলো আমার ছেলে ঈশানের নিষ্পাপ মুখ l এমন সময়  হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম l ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটা, আমি একাই ওয়েটিং রুমে বসে l ওয়েটিং রুম থেকে দেখছি আকাশ ছিন্ন করে জলধর তার সর্বশেষ জলবিন্দু  দিয়ে হলেও নির্জন শহরকে ধুয়ে , যেন তার সমস্ত কালিমা মুছে দিচ্ছে l গোটা শহর আজ স্নাত, পরিশুদ্ধ l

আমার চোখটা বুজে এলো l আবার ঈশানের মুখ ভেসে উঠলো l আচ্ছা, নিশ্চয়ই মল্লিকাই ওর কাস্টডি পাবে, মা বলে কথা l তখন ঈশানকে ও আমার কাছে আসতে দেবে? খুব মিস করবো ঈশানকে l আমি যে ওকে খুব ভালোবাসি l ভাবতে ভাবতে, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম l  হঠাৎ শুনতে পেলাম :

'কাকু! ও কাকু!'

আচমকা, আমার ঘুম ভেঙে গেল l চোখ খুলে দেখলাম, আমার সামনে একটা তেরো - চৌদ্দ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে l পরনে একটা টি শার্ট আর হাফ প্যান্ট l দেখে ভদ্র ঘরের ছেলেই মনে হচ্ছে l আমি অবাক হলাম, এতো রাতে একা একটা বাচ্চা ছেলে,এখানে কী করছে?

ছেলেটি আবার বলল  : 'কাকু! ট্রেন কখন আসবে?'

আমি : 'ভোর ৫টার আগে ট্রেন নেই l তুমি কোথায় যাবে?'

ছেলেটি : ' ব্যারাকপুর l'

আমার যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি গেলো,  আমি আর এই ছেলেটি ছাড়া, আর কেউ চোখে পড়লোনা l এমনকি স্টেশনে একটা কুকুর পর্যন্ত নেই l আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম : ' তোমার সাথে কে আছেন?'

ছেলেটি : 'কে থাকবে? কেউ নেই l আমি একাই যাবো l'

আমি আরও অবাক হলাম : 'এতো রাতে একা?'

ছেলেটি : ' তো কী হয়েছে? আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি l একাই যেতে পারবো l'

আমি বুঝলাম, ডেপো ছেলে l সবে গোঁফের রেখা উঠেছে তো , তাই নিজেকে হিরো দেব ভাবছে l হয় হয়, এই বয়সে এমন হয় lমনে হয়, বাড়ি থেকে পালিয়েছে l সকাল হলেই, জি. আর. পি. এফ এর কাছে দিয়ে আসবো l কোন বাড়ির ছেলে, কে জানে l আমি এবারে জিজ্ঞাসা করলাম : 'তোমার নাম কী? ব্যারাকপুরে কারোর বাড়ি যাচ্ছো?'

ছেলেটি : 'আমার নাম ঋদ্ধি l আমি ব্যারাকপুরে আমার দিদির বাড়ি যাচ্ছি l'

আমি কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম : ' কেন জানতে পারি? '

ঋদ্ধি মুখ বেকিয়েই বলল  : 'আর বলোনা কাকু! মা বাবা শুধু ঝগড়া করে l আমার একদম ভালো লাগেনা l তাই আমি দিদির কাছে চলে যাবো l'

আমি : 'মা বাবা ঝগড়া করলে বুঝি এভাবে চলে যেতে হয়? তুমি মা বাবাকে বোঝাও, যাতে তারা ঝগড়া না করেন l'

ঋদ্ধি  : 'ওরা বুঝবেনা l ওরা শুধু ঝগড়া করবে l চিৎকার করবে l আর আমি দরজা বন্ধ করে কান চেপে রাখি l আমার মাথায় যন্ত্রনা করে, আমি ওদের চিৎকার সহ্য করতে পারিনা l আমি পড়াশোনা করতে পারিনা l'

আমার মনে আবার ঈশানের মুখ ভেসে এলো l আমার আর মল্লিকার যখন ঝগড়া হয়, তখনও হয়তো ঈশান এইভাবেই ভয়ে কুঁকড়ে থাকে l কিংবা হয়তো ওরও খুব কষ্ট হয় l

ঋদ্ধি বলতেই লাগলো : 'জানোতো কাকু, মা বাবা আগে খুব ভালো ছিল l আমরা তিনজনে মিলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম l কতো মজা করেছি l ওরা যখন ঝগড়া করে, আমি পুরীর সেই ছবিগুলো দেখি l মনে হয় আবার এমন দিন কবে আসবে l বাবাকে যখন বলি  বাবা পুরী যাবো l বাবা বলে, সামার ভ্যাকেশনে যাবো l সামার ভ্যাকেশন এলে  বলে পুজোর ছুটিতে যাবো l আসলে আমি জানি, বাবা আমাদের আর পুরীতে নিয়ে যাবেনা l '

আমার আবার ঈশানের কথাই মনে পড়ল l ঈশানও তো ভূগোল বইতে কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্পর্কে পড়ে, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চেয়েছিলো l বলেছিল পুজোর ছুটিতে নিয়ে যেতে l আমিও ওকে কথা দিয়েছিলাম যে, নিয়ে যাবো l

ঋদ্ধি আরও বলতে লাগলো : 'জানোতো কাকু, আগে দুর্গাপুজোর সময় আমি, মা বাবা দুজনের সাথে ঠাকুর দেখতে যেতাম, কতো মজা হতো l এখন হয় মা আমায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায়, নয় বাবা আমায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায় l আমি মা বাবা একসাথে কোথাও যাইনি, একসাথে খাইনি, একসাথে গল্প করিনি - কতদিন হয়ে গেলো l ওরা খুব ঝগড়া করে l বলছে আলাদা আলাদা থাকবে l আমি শুনেছি l কিন্তু আমার খুব কষ্ট হবেl আমি তো দুজনের সাথেই থাকতে চাই l আমার আর ভালো লাগছেনা l তাই আমি দিদির কাছে যাবো l'

আমার কাছে তো ঋদ্ধি, ঈশানের মতোই l ঈশানেরও হয়তো এমনটা মনে হয় l এতোদিন এতো অশান্তি, জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে আমি আর মল্লিকা কেউই ঈশানকে নিয়ে তো একবারও ভাবিনি, যে ও কী চায় l আমি আবার চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলাম l কানে এলো- 

'ডাক্তারবাবু, কাল রাত কেমন কাটল? আপনার ট্রেন আসার সময় তো হয়ে এলো l'

সামনে তাকাতে দেখতে পেলাম সুবলদা দোকানের ঝাঁপি তুলছেন l রাতের কালিমা কেটে সূর্যদেব সহাস্যে জাগ্রত হয়েছেন l কিন্তু,পাশে তাকাতেই বুকটা ছ্যাক করে উঠলো  - একি! ছেলেটা কোথায়? কোথায় গেলো? আমি দৌড়ে ওয়েটিং রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি,কোত্থাও ছেলেটি নেই l

আমি প্রায় হন্তদন্ত হয়ে সুবলদাকে জিজ্ঞাসা করলাম :'দাদা একটা বাচ্চা ছেলেকে কী আপনি দেখেছেন? তেরো চৌদ্দ বছর হবে l হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পড়া l'

সুবলদা বিস্মিত হয়েই বললেন  : ' না তো ডাক্তাবাবু! কাউকে দেখিনি l তবে দিন সাতেক আগে একটা তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে ট্রেনে কাটা পড়েছিল l সে নাকি তাড়াতাড়ি দৌড়ে লাইন পার হতে গিয়েছিল l আর ওই সময় ট্রেন দিয়েছে ধাক্কা l'

আমি শুনে স্তব্ধ, বাক্যহারা l নিজের চোখ, কান, পঞ্চইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না l একটা জ্বলজ্যান্ত ছেলে এভাবে নিমেষে উধাও হয়ে গেল l আবার আমার ফোনটা বেজে উঠলো l ফোনটা বের করতেই দেখলাম, স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে - ' মল্লিকা ইস কলিং l' ফোনটা কানে দিয়ে বললাম : 'হ্যাঁ, বলো 'l

ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো মল্লিকার কাতর কণ্ঠস্বর : ' শোনো, বলছি,তুমি কী আজকে আমার বাড়িতে আসতে পারবে? ঈশানের খুব জ্বর l কাল রাতে কাঁদতে কাঁদতে ওর জ্বর এসে গেছে l ও মনে হয় আমাদের ব্যাপারটা বুঝে গেছে আর আপসেট হয়ে পড়েছে l সবকিছু ভুলে নতুন করে কী আবার শুরু করা যায়না? অন্তত ঈশানের জন্য?'

আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো l আমি বললাম : 'এই ব্যাপারে তোমার সাথে আমিও কথা বলবো মল্লিকা l আমি  যাবো l ঈশানকে দেখে রেখো l'

ভুল তো মানুষ মাত্রই করে l আবার ভুল থেকেই 

 তো মানুষের শিক্ষা  হয় l আমরাও ভুল করেছিলাম l এখন সেই ভুলগুলোকে শুধরে অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে, ঈশানের জন্য, আমাদের নিজেদের জন্য l গতকাল রাতের  বারিধারা শহরের কালিমার সাথে সাথে, আমার মনের কালিমা, আর ভুলগুলোকে যেন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে l আজকের সকালটা যেন আমার নবজীবনের নবসকাল l

ইতিমধ্যে ট্রেন চলে এসেছে l ভোরের ট্রেন তো, বেশ ফাঁকা l ভোরের মিঠে আলোতে ট্রেনের কামরার ভিতরটাও সোনালী আভায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে lমনটাও বেশ হালকা লাগছে l মনে হচ্ছে, এতদিনের বহন করা কতো বোঝা, কতো ভার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি l তবে,একটা প্রশ্ন মনে বারবার আসছে,হয়তো এই প্রশ্ন আমার মনে সারাজীবন থেকেও যাবে -  মাঝরাতে আসা যে ছেলেটি এতক্ষন ধরে  আমার সাথে এতো কথা বলল - সে কী আদৌ মানুষ? নাকি কোনো দেবদূত? নাকি ট্রেনে কাটা পড়া সেই ছেলেটির..............????

লিখেছেন...

Sayani Gupta Banerjee


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন