মিষ্টি সম্পর্ক

 গল্প : মিষ্টি সম্পর্ক

নীরা নতুন অফিসে জয়েন করতে, বস মিস্টার সেন নীরাকে নিয়ে একটা রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, “একটা নতুন প্রোজেক্ট শুরু হচ্ছে, আপনি ওতে যোগ দিন। ওদের একজন প্রোগ্রামার লাগবে।”

রুমে ঢুকে নীরা দেখল সেখানে ছজন বসে আলোচনা করছিল। সবাইকে সম্বোধন করে মিস্টার সেন বললেন, “উনি আপনাদের প্রোজেক্টে প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেবেন। ওনার নাম নীরা চ্যাটার্জি।” ওই গ্রুপে মাঝে বসা নীল রঙের জামা পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে নীরাকে মিস্টার সেন বললেন, “উনি হচ্ছেন প্রোজেক্ট ম্যানেজার কৌশিক ব্যানার্জি, ওনার আন্ডারে আপনি কাজ করবেন।”

নীল জামা পড়া লোকটা মানে কৌশিক একটু বিস্ময়ের সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল এই ভাবে তাকানো অশোভনীয়, তাই সাথে সাথে হ্যান্ড শেক করার জন্য হাত বাড়াল। কৌশিককে দেখেই নীরা কি রকম থতমত খেয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে, কিন্তু এতো ভালো চাকরি ছাড়বে কি করে? আগের চাকরিটা হারিয়ে ফেলেছে। কৌশিক একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। নিরুপায় হয়ে আমতা আমতা করে নীরাও হাত বাড়াল।

মিস্টার সেন বাকি পাঁচজনের সাথেও পরিচয় করালেন, চারজন ছেলে রিজু, মির, রাকিব আর সোহাম আর একজন মেয়ে তিস্তা। নীরা বাকিদের সাথেও হাত মেলালো। কৌশিক ওকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বসুন”। নীরা যন্ত্রচালিতের মত সামনের চেয়ারে বসল। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। মিস্টার সেন বললেন, “আপনারা কাজ করুন আমি যাই।”

নীরার খুব ইচ্ছে করছিল মিস্টার সেনকে বলতে অন্য প্রোজেক্টে যোগ দিতে চায়। নতুন জায়গায় কি করে বলবে? মনে মনে ভাবল, ছাড়তে তো যেকোনো দিন পারবে। চাকরি করতে বেরোলে এতো সব ভাবলে চলবে না। সাথে কে কাজ করছে দেখলে চলবে না। নিজের কাজ করে বেরিয়ে যেতে হবে।

বাকিরা আলোচনা করে যাচ্ছে, ও শোনার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুই মাথায় নিতে পারছে না। বারে বারে চোখ ঘড়ির দিকে যাচ্ছিল, কতক্ষণে মুক্তি পাবে এখান থেকে। নীরার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝে কৌশিক দু একবার নীরার দিকে তাকাল, কিন্তু নীরা নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছিল। বিকেল সাতটা নাগাদ কৌশিক বলল, “আজ ওঠা যাক। কাল বাকিটা ডিসকাস করে নেব। মিস চ্যাটার্জি আমি কিছু পেপার দিচ্ছি, বাড়ি গিয়ে পড়ে নেবেন। আমাদের প্রোজেক্টের সম্বন্ধে আপনার কিছুটা আইডিয়া হয়ে যাবে।”

সবাই উঠে পড়ল রুম থেকে বেরোবার জন্য। কৌশিক নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, “এক মিনিট অপেক্ষা  করবেন আপনি। আমি কাগজগুলো আলমারি থেকে বের করে দিচ্ছি।”

নীরা ঠিক এই মুহূর্তটা এভয়েড করতে চায়ছিল। কিন্তু এখন কি করবে? মাথায় কিছু আসছে না? বাকিরা সবাই বেরিয় যাচ্ছে। সহকর্মী মহিলাটির নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। কোন রকম বলল, “হ্যালো ম্যাম!”

তিস্তা হ্যালো ম্যাম শুনে ঘুরে তাকাল। নীরা বলল, “আপনার সাথে একটু দরকার ছিল।”

তিস্তা একবার কৌশিকের দিকে তাকাল। কৌশিক নীরার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল, তারপর তিস্তাকে বলল, “আপনিও বসুন।”

কৌশিক আলমারি থেকে কিছু কাগজ বার করে দিতেই নীরা সেগুলো নিয়ে কোন রকম ব্যাগে ঢুকিয়ে তিস্তার সাথে বাইরে বেরিয়ে গেল। তিস্তার নীরার এই ব্যবহার একটু অস্বভাবিক মনে হচ্ছিল। তাছাড়া নীরার কপালে ঘাম দেখে সামথিং ইজ রং মনে হচ্ছিল। তাই নীরাকে বলল, “আপনার শরীর ঠিক আছে? এত ঠাণ্ডাতেও কি রকম ঘেমে গেছেন।”

নীরা আমতা আমতা করে বলল, “না আসলে সারাদিন খুব ধকল গেছে। দুর্গাপুর থেকে আজকেই এসেছি। কোন ভোরে উঠেছি তাই একটু ক্লান্তি লাগছে।”

তিস্তা বলল, “আপনি কোলকাতায় থাকেন না?”

নীরা, “না আমি এখানে থাকি না। আগের চাকরি খড়গপুরে ছিল। সেখানে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। গত মাসে কোম্পানিটা উঠে গেছে।”

তিস্তা, “আজ কোথায় থাকবেন?”

নীরা বলল, “আজ লাবনির কাছে একটা গেস্ট হাউস বুক করেছি। দু একদিনের মধ্যে একটা ভাড়া বাড়ি খুঁজে শিফট হয়ে যাব।”   

 নীরা তিস্তার সাথে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করে নিল। এক সাথে অফিস থেকে বেরোতো। টিফিন এক সাথে খেতো। যেকোনো প্রকার কৌশিকের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করত। কৌশিক দু একবার চেষ্টা করেছিল নীরার সাথে একা কথা বোলার, কিন্তু যখন বুঝল নীরা ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছে সেও আর নীরার সাথে একটা দুরত্ব বোজায় রাখা শুরু করল।

নীরা তিস্তার সহযোগিতায় ওর বাড়ির কাছে সল্টলেকে একটা ভাড়ায় ফ্ল্যাট জোগাড় করে শিফট হয়ে গেল। পাশাপাশি থাকার ফলে দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। নীরা তিস্তার সাথে অফিসে আসা আর যাওয়া শুরু করল, তাতে কৌশিককে এড়িয়ে যাওয়া খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। 

নীরা খড়গপুর থেকে ইন্ডাকশন আর বাসনগুলো নিয়ে চলে এসেছিল। মাঝে মাঝে নিজে রান্না করতো আবার কখনও হোম ডেলিভারি থেকে আনিয়ে নিত। মাঝে মাঝে তিস্তাও নীরাকে নিজের বাড়ি ডিনারের জন্য ডেকে নিত। দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। ঠিক এমন সময় একদিন রাত একটায় নীরার ফোন বেজে উঠল। এতো রাতে কে আবার ফোন করল? ঘুমের মধ্যে ফোনটা ধরল। ওপার থেকে ভীত মায়ের আওয়াজ এল, “নীরা বাবার বুকে ব্যাথা করছে। কি করি এত রাতে?”

বাবার বুকে ব্যাথা শুনেই নীরার মাথা ঘুরতে লাগল। এত  দূর থেকে দুর্গাপুরে কি করে সাহায্য করবে? মা একা কি করবে? কার সাথে যোগাযোগ করা যাবে? ওর সব বন্ধুরা তো বাইরে থাকে। আত্মীয়রাও কেউ দুর্গাপুরে থাকে না। তিস্তাকে ফোন করে কোন লাভ নেই। নিরুপায় হয়ে কৌশিককে ফোন করল। কৌশিক এতো রাতে নীরার ফোন দেখে একটু চমকে গেল। ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, “কি হল? এতো রাতে ফোন করলে?”

নীরা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “মা একটু আগে ফোন করেছিল, বাবার নাকি বুকে ব্যাথা উঠেছে। মা একা আছে বাড়িতে। কি করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।”

কৌশিক একটু ভেবে বলল, “দেখি কি করতে পারি।”

কৌশিক ফোন রেখে দিল। কিন্তু নীরার অস্বস্তি বেড়েই চলল। কি করবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছে করছিল ছুটে বাবা মায়ের কাছে চলে যায়। কিন্তু এতো রাতে সেটা কি করে সম্ভব?

দশ মিনিটের মধ্যে কৌশিক আবার ফোন করে বলল, “মাকে বলো একটু টাকা নিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে। পনেরো মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে। নার্সিং হোমের সাথেও যোগাযোগ করেছি। নার্সিংহোমের টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। সেটা আমি পাঠিয়ে দেব। তুমি তৈরি হয়ে থাকো দুর্গাপুর যাওয়ার জন্য, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি।”

নীরা মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল খবরটা। এত সহজে সমস্যার সমাধান হবে ভাবতেও পারেনি। আশায় করেনি বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেও এতো তাড়াতাড়ি পূর্ণ হয়ে যাবে। ভেবেছিল সকালের আগে বাড়ির জন্য বেরোতে পারবে না। তাড়াতাড়ি আলমারির সামনে পড়া কিছু জামা কাপড় ব্যাগে ভরে নিল। সামনে হ্যাঙ্গারে টাঙ্গানো জিন্স আর টি শার্ট পরে নিজেও তৈরি হয়ে গেল। 

মায়ের কাছে থেকে খবর পেল বাবাকে আই সি ইউতে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তাররা দেখছে। মায়ের কথা শুনে নীরা কিছুটা স্বস্তি অনুভব করল। আধ ঘণ্টার মধ্যে কৌশিক গাড়ি নিয়ে চলে এল। নীরা বেরিয়ে পড়ল কৌশিকের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়ি ছুটে চলল দুর্গাপুরের দিকে। বড় রাস্তা ছোটো রাস্তা, হাইওয়ে ধরে ছুটছে গাড়ি। নীরার মনটাও ছুটছে নিজের অতীত জীবনের অলিগলি দিয়ে।

নীরা আর কৌশিক দুজনে দুর্গাপুরের এন আই টি থেকে সি এস সি নিয়ে বিটেক পাস করেছিল। তারা ব্যাচমেট ছিল। নীরা নবীনবরনের দিন কৌশিকের আবৃতি শুনে ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কৌশিকেরও নীরাকে বেশ ভালো লেগেছিল। দিনে দিনে ওদের বন্ধুত্ব প্রগাড় হয়ে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল।

নীরা দুর্গাপুরের মেয়ে ছিল তাই বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করত। কৌশিক ধানবাদের ছেলে ছিল তাই হোস্টেলে থাকত। প্রায় দিন নীরা কৌশিককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে মায়ের হাতের রান্না খাওয়াত। কৌশিকেরও নীরার মায়ের হাতের রান্না খুব পছন্দ ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চারটে বছর ওরা চুটিয়ে প্রেম করেছিল। ক্লাস শেষ হতে দুজনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে বসে গল্প করত। দুজন পড়াও এক সাথে তৈরি করে নিত। প্রতি রবিবার এক সাথে সিনেমা দেখতে যেত। কলেজে ওদের জুটির নাম রোমিও আর জুলিয়েট পড়ে গিয়েছিল। 

 বিটেক পাস করে দুজনই একই কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল। ওদের বাড়ি থেকে এই সম্পর্কে কারও আপত্তি ছিল না। দুজন কোলকাতা শহরে আলাদা আলাদা থাকছিল। বিয়ে যখন ওরা একে অপরকেই করবে তো অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না, তাই দুই বাড়ির লোক মিলে ওদের চার হাত এক করে দিল। হানিমুনে সিঙ্গাপুর ঘুরতে গেল। বিয়ের প্রথম ক মাস বেশ আনন্দেই কাটল। কিন্তু বিয়ের যত দিন গড়াচ্ছে, একের পর এক সমস্যা আসতে লাগল। দুজনের অফিস টাইমের কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না, কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। বাড়ির কাজ নিয়ে সমস্যা হতে লাগল। দুজনই নিজের মা বাবার এক মাত্র সন্তান, খুব আদরে বড় হয়েছিল। বাড়ির কোন কাজ শেখেনি। বাড়িতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে কৌশিক আশা করে নীরা রান্না করবে, কিন্তু নীরা ভাবে সেও তো একই রকম পরিশ্রম করে এসেছে, সেই বা রান্না করবে কেন? ঘর মুছবে কেন? বাসন মাজবে কেন? 

বাড়িতে আত্মীয় এলে কৌশিক আশা করে ওদের দেখাশোনা করার জন্য নীরা ছুটি নিয়ে বাড়ি থাকবে। কিন্তু নীরা ভাবে সেই কেন ছুটি নেবে? পালা করে কৌশিকও নিক। বাড়ির কাজের চাপে ওদের সম্পর্ক নষ্ট হতে লাগল। একে অপরের সাথে ঠিক ভাবে কথাও বলত না। অফিসেও একে অপরকে অপমান করার সুযোগ ছাড়ত না। শেষে দুজনেই ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছিল। নীরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে খড়গপুরে একটা চাকরি ধরল। তারপর দীর্ঘ দশ বছর আর যোগাযোগ ছিল না। দুজন নিজের চাকরি আর উন্নতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। 

গাড়িতে বসে নীরা মাঝে মাঝে কৌশিকের দিকে ঘুরে তাকাছিল। তার খুব খারাপ লাগছিল কৌশিককে এই ভাবে মাঝ রাতে কষ্ট দিতে। কৌশিক এক মনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। নীরা বাড়িতে ফোন করলে বা বাড়ি থেকে ফোন এলে শুধু কৌশিক খবর জানার জন্য নীরার দিকে ফিরে তাকাছিল। নীরা খবরটা জানিয়ে দেওয়ার পর আবার কৌশিক এক মনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। এতো লম্বা সফরে খুব প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা কৌশিক নীরাকে জিজ্ঞেস করেনি।

রাস্তা ফাঁকা ছিল, তাই ওরা সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্য দুর্গাপুরে নার্সিংহোমে ঢুকে গেল। মা নীরাকে দেখতে পেয়ে পায়ের তলায় জোর খুঁজে পেল। এতক্ষণ দিশাহারা হয়ে বসেছিল। ছুটে এসে নীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। নীরাও মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। নীরার মা কৌশিককে দেখে বেশ খুশি হল। কৌশিক নীরার মায়ের পা ছুয়ে প্রণাম করল। নীরার মা কৌশিকের চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেল আর আশীর্বাদ করল, “জীবনে অনেক উন্নতি কর বাবা!”

  নীরার মা চিরকাল কৌশিককে খুব ভালোবাসে। তার মতে নীরা আর কৌশিকের ডিভোর্সের কারণ নীরাই। নীরার মায়ের ভাবনা বৌয়ের চোখে বরের মান সম্মান বারে যদি বর ভালো চাকরি করে আর  বরের চোখে ভালো বৌ সেই যে ভালো রান্না করতে পারে, ঘর ভালভাবে গুছিয়ে রাখতে পারে, সুন্দর ভাবে বাচ্চা মানুষ করতে পারে আর বাড়ির সবার যত্ন নিতে পারে। সেই দিক থেকে কৌশিক ভালো বর, যেহেতু খুব ভালো চাকরি করে, কিন্তু তার মেয়ে বৌ হিসেবে দক্ষ নয়। রান্না খুব ভালো জানে না। ঘর গোছানোতেও খুব একটা উৎসাহ নেই। নিজের যত্নই ঠিক নিতে পারে না। বাচ্চা তো নিতেই চায় না। তাই কৌশিকের পক্ষে এই ধরণের মেয়ের সাথে মানিয়ে না নিতে পারা খুব স্বাভাবিক।

নীরার বাবার শারীরিক অবস্থা একটু স্থিতিশীল হতে কৌশিক ফিরে গেল কোলকাতায়। নীরাকে বলে গেল, এখুনি কাজে যোগ দেওয়ার দরকার নেই, সে সামলে নেবে। বাবা আর একটু সুস্থ হলে এখান থেকেই কাজে জয়েন করে। পুরোপুরি ঠিক হলে নীরা কোলকাতায় ফিরে যায়, তার আগে নয়।

নীরা বুঝতে পারছিল না কৌশিকের কাছে কি ভাবে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কৌশিক ফিরে যাওয়ার সময় নীরা কৌশিকের হাত ধরে বলল, “তুমি না থাকলে কি হত আমি ভাবতেও পারছি না। আমি সার জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।”

কৌশিক হাল্কা করে নীরার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ইটস ওকে। আমি এমন কিছু করিনি। বাবা মায়ের খেয়াল করো।”

বাবা পুরো সুস্থ হয়ে যেত নীরা কোলকাতায় ফিরে গেল। কিন্তু এখন আর নীরা কৌশিককে এড়িয়ে চলে না। ওদের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠল। অফিসের কাজ একে অপরের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করে। কিন্তু কেউ কারও প্রতি বিশেষ আকর্ষণ দেখাত না। ওদের প্রোজেক্টের কাজ বেশ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিল। এক দিন তিস্তা নীরাকে বলেই ফেলল, “কদিন আগে অব্দি দেখতাম তুই কৌশিকদার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতিস। এমন কি হল যে এখন বেশ সুন্দর ভাবে গল্প করিস কৌশিকদার সাথে। কৌশিকদাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি, কারও প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখিনি। কিন্তু আজকাল দেখি তোকে একটু অন্য চোখে দেখে।” 

নীরা একটা মিষ্টি হাসি হেসে বলল, “না রে, আগে ভয় পেতাম, এখন আর ভয় পাই না।” ইচ্ছে করে সত্য কথা গোপন করে গেল নীরা। নিজের অতীত ঘাঁটতে চায়নি সে।

আরও কয়েক মাস যেতে একদিন কৌশিক অফিস এলো না। নীরা চিন্তায় পড়ে গেল। ও তো সহজে কামাই করে না। এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করতে বুঝল কৌশিকের জ্বর হয়েছে। বাথরুমে গিয়ে কৌশিককে ফোন করল। কৌশিক মুখে বলল ভালো আছে, কিন্তু গলার আওয়াজে নীরা বুঝতে পারল কৌশিক খুব একটা ভালো নেই। অফিস শেষ হতেই সোজা কৌশিকের ফ্ল্যাটে চলে গেল। দু বছর এই ফ্ল্যাতেই ছিল তাই বিল্ডিং চিনতে অসুবিধে হয়নি। দশ বছর পরেও পানগুমটি, রঙ্গন গাছ সব ওই রকমই আছে। অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান সেই রবিদাই আছে। ওকে চিনতেও পারল। এতো দিন পরে দেখছে বলে একটু চমকে গেল। একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন বৌদি?”

বৌদি শুনে নীরার একটু অস্বস্তি হল। সেই সম্পর্ক অনেক আগে চুকে গেছে। তবুও কিছু বলেনি সেই ব্যাপারে। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নীরা দারোয়ানকে বলল, “ভালো, আপনি ভালো আছেন তো?”

দারোয়ান ওর সাথে লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ভালো আছি।” লিফটের কাছে এসে নীরাকে লিফটের দরজা খুলে দিল। নীরা উঠে লিফটের দরজা বন্ধ করে দিল আর চার টিপল। লিফট পাঁচতালায় এসে থামল। লিফট থেকে বেরিয়ে একটু বাঁ দিকে হাঁটতেই কৌশিকের ফ্ল্যাট। দরজার গায়ে নেম প্লেটে এখনও লেখা আছে কৌশিক ব্যানার্জি আর নীরা ব্যানার্জি। কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল নেম প্লেটের দিকে তারপর আস্তে করে হাত বাড়াল কলিংবেলের দিকে। কলিংবেল বাজার প্রায় দু মিনিট পর দরজা খুলল। সামনে নীরাকে দেখে কৌশিক চমকে গেল। বলল, “তুমি!”

নীরা বলল, “তোমার শরীর খারাপ শুনে এলাম। এখন কেমন আছো?”

কৌশিক নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, “একটু গরম আছে মনে হয়। টেম্পারেচার দেখিনি।”

নীরা আসার সময় প্যারাসিটামল আর থার্মোমিটার কিনেই এনেছিল। ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বার করে কৌশিকের টেম্পারেচার চেক করল, এক শো দুই জ্বর। নীরা কৌশিককে জিজ্ঞেস করল, “কিছু খেয়েছো?”

কৌশিক বলল, “কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, তাই খাইনি।”

নীরা রান্না ঘরে গিয়ে দেখল কিছু খাবার জিনিস আছে কি না। শুধু বিস্কুট চোখে পড়ল। ফ্রিজেও কিছু পেল না। র চা আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে এসে বলল, “এইগুলো খেয়ে নাও, তারপর জ্বরের ওষুধ দেব।”

কৌশিক বলল, “ইচ্ছে করছে না খেতে।”

নীরা একটা ধমক দিল, “চুপচাপ খেয়ে নাও।” ধমক দিয়েই নীরা লজ্জায় পড়ে গেল। এখন কৌশিকের উপরে তার সেই জোর থাকার কথা নয়। কৌশিক নীরার দিকে চেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। দেখতে পেল দশ বছরের আগের নীরাকে। কৌশিক ভালো ছেলের মত চুপচাপ চা বিস্কুট খেয়ে নিল। নীরা একটু পরে ওষুধ আর জল কৌশিকের দিকে এগিয়ে দিল। সেটাও সে চুপচাপ খেয়ে নিল।

কৌশিকের ডেঙ্গু ধরা পড়ল। কৌশিক নিজেকে পুরোপুরি নীরার হাতে ছেড়ে দিল। নীরা নিজের বাড়ি গিয়ে নিজের কিছু জামা কাপড় আর কিছু প্রয়োজনের জিনিস নিয়ে চলে এল। নীরা রাতদিন জেগে কৌশিকের সেবা করে গেল। কৌশিকের গা স্পঞ্জ করাতে গিয়ে নীরা দশ বারো বছর আগেকার মধুর স্মৃতিতে হারিয়ে যেত আর নিজের অজান্তেই কৌশিককে জড়িয়ে ধরত। সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পারত আর ছেড়ে দিত। কৌশিক প্রথম কয়েকবার চমকে গিয়েছিল। নীরা জড়িয়ে ধরলে ওরও খুব ভালো লাগত, তাই তারপর থেকে নীরা ওকে জড়িয়ে ধরলে সেও নীরাকে জড়িয়ে ধরত। কৌশিক সুস্থ হতে লাগল আর সাথে সাথে ওদের সম্পর্কের গভীরতাও বাড়তে লাগল। জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো ওরা আবার খুঁজে পেতে লাগল। বিয়ের প্রথম দিকে যেমন তারা একে অপরকে সম্পূর্ণ রুপে পেত, ঠিক সেই মুহূর্ত আবার ওদের জীবনে ফিরে এল। 

 জ্বর একটু কমতে শুরু করতে নীরা কৌশিকের বাড়ি থেকে ওয়ার্ক ফ্রাম হোম শুরু করল, যেহেতু প্রোজেক্ট ম্যানেজার কৌশিক ছিল তাই অনুমতি পেতে অসুবিধে হয়নি। কৌশিক আরও একটু সুস্থ হতে নীরা কৌশিকের বাড়ি থেকেই অফিস যেতে শুরু করল আর কৌশিক বাড়ি থেকে ওয়ার্ক ফ্রাম হোম করতে লাগল। নীরা বাড়ি ফিরে এসে দেখতো কৌশিক ঘরটা সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রেখেছে। রান্নাও করে রেখেছে। ওর রান্না খেয়ে নীরা অবাক হয়ে একদিন বলল, “খুব ভালো রান্না করছো! কোথায় থেকে শিখলে?”

কৌশিক হাসতে হাসতে বলল, “সময় অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে।” 

 কৌশিক পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল। পরেরদিন থেকে কৌশিক অফিস যাবে মনস্থির করল। নীরা নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। ওকে ব্যাগ গোছাচ্ছে দেখে কৌশিক নীরাকে পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন?”

নীরা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমি পুরো সুস্থ হয়ে গেছো, তাই এবার আমার ফিরে যাওয়ার পালা।”

কৌশিক, “কি দরকার ভাড়া বাড়িতে পড়ে থাকার। চলো আবার থেকে নতুন ভাবে জীবন শুরু করি।”

নীরা কৌশিকের দিকে ঘুরল। দু হাত দিয়ে কৌশিকের গলা জড়িয়ে কৌশিকের চোখের দিকে তাকাল। কৌশিকের চোখের মধ্যে বিয়ের আগের ভালোবাসা আবার খুঁজে পেল। বলল, “তোমার এই ভালোবাসা আমি হারাতে চাই না। এক সাথে বেশিদিন থাকলে আমরা খুব হিসেবি হয়ে উঠি। কি দিলামের থেকে আমাদের কাছে কি পেলাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের এই মিষ্টি সম্পর্ক বোজায় রাখতে একটু দূরেই থাকি। সুখে দুঃখে ঠিক এই ভাবেই একে অপরের পাশে থাকব।” 

কৌশিক কোন কথা বলতে পারছিল না। তারও নীরাকে ছাড়তে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখ ছলছলে হয়ে এল। কিন্তু নীরার কথা যে কটু সত্য সেটা অস্বীকার করতেও পারছিল না। নীরা কৌশিকের ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বলল, “চলি”। আস্তে করে নিজেকে কৌশিকের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল। জানে আর এক মুহূর্ত থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে।       

 সুনন্দী কামাথ

(সমাপ্ত)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন